চেয়ারম্যান সেলিমের অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে দুদক

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট
চাঁদপুর সদরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার (৬ এপ্রিল) দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে এ সত্যতা পায় দুদক কর্মকর্তারা।

চাঁদপুরের নদী থেকে বছরের পর বছর অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে প্রকৃতি-পরিবেশ বিনষ্টসহ বিপুল অংকের রাজস্ব ক্ষতি এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলেয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে সরকারের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা লুটপাটের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির কমিশনের নিকট বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।

দুদকের সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, জমি অধিগ্রহণে কৌশলে জমির মূল্য প্রায় ২০ গুণ বেশি দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি, মেঘনা নদীতে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করে পরিবেশের অপরিসীম ক্ষতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জন বিষয়ে চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যাচাইয়ে ৬ এপ্রিল দুদক কুমিল্লা’র সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস্ সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়।

অভিযানকালে দুদকের টিম চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর মৌজায় চাঁদপুর-হাইমচর সড়কের পাশে মেঘনা নদী থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমি সরেজমিন পরিদর্শন করে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, বিআইডব্লিউটিএ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে অভিযোগ সম্পর্কিত রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।

নদী থেকে বালু তুলতে পারবেন না সেলিম চেয়ারম্যান: আপিল বিভাগ
টিমের সংগৃহীত রেকর্ডপত্রে চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা অংশে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিনষ্টসহ রাজস্ব ক্ষতি এবং প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে সরকারের বিরাট অঙ্কের অর্থ লুটপাটের দূরভিসন্ধি সম্পর্কে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। টিম এ বিষয়ে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দ্রুত কমিশনের নিকট বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ের একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, ওই ইউপির চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েক শ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।

ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।

এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার অন্যান্য সাফকবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়ত।
এদিকে, সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি অংশ। সরকারি অর্থ লোপাট চেষ্টার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে চাঁদপুর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করায় চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন।

অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।

চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন
এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
ওই চিঠির পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে সম্পৃক্ত নৌযান জব্দ ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ।

সবশেষ ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের (লিভ টু আপিল) পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৪ এপ্রিল) এ আদেশ দেন চেম্বার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। ২৫ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বালু উত্তোলনের অনুমতি বাতিলের বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply