দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীরা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছেন :  জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ

চাঁদপুরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত
: নিজস্ব প্রতিবেদক :
“করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব” ও “টেকসই উন্নয়ন সুশাসন: নেতৃত্বে নারী ও সমতা” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, চাঁদপুরের আয়োজনে সনাক-টিআইবি’র সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২১ উপলক্ষে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল জেলা প্রশাসনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে নারীর ক্ষমতায়নের অনন্য সহযাত্রী চাঁদপুরের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশকে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী।

গতকাল ৮ মার্চ সোমবার সকাল ১১টায় আলোচনা সভা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, করোনা মোকাবেলায় নারীরা সম্মুখসারীর যোদ্ধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীরা আজ আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও সরকার নারীদের সাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, সকল ক্ষেত্রে নারীরা আজ অনেক এগিয়ে। নারীদের প্রতিটি ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সমাজ ব্যবস্থায় নারী ও পুরষকে সমানভাবে দেখতে হবে। আমাদেরকে সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা যদি নারীদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি করে কাজে লাগাই এবং তাদেরকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেই তাহলেই আজকের এই নারী দিবসের সার্থকতা আসবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, অধিকার কেউ দেয় না, অর্জন করতে হয়। আদায় বা অর্জন যুদ্ধ দিয়ে নয় যোগ্যতা দিয়ে করতে হবে। অনেকাংশে অনেকে নারীদের অগ্রগতি মেনে নিতে পারছে না।
জেলা প্রশাসক নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি যেন পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত না হন তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আপনাদের নির্যাতনের কথা লুকিয়ে না রেখে প্রশাসনকে অবহিত করবেন। আপনারা আপনার মেয়ে সন্তাকে যথাযোগ্যভাবে গড়ে তুলবেন।
তিনি আরও বলেন, পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া নারীরা কখনো এগিয়ে যেতে পারবে না। তবে এখনো নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। করোনাকালে নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, নারীদের দিয়ে কাজ হয় না একথাগুলো পরিহার করতে হবে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি টিআইবি’র ধারনাপত্রের আলোকে বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে ২০২১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে। এ সময়কালে বাংলাদেশে গত তিন বছরের সর্বোচ্চসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এ সময়কালে ১ হাজার ৭ শত ১১ জন নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আরো ৩ শত ৪৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়ে ৫৫ জন মারা গেছেন এবং ১৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫ শত ৫৪ জন নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩ শত ৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২ শত ১৮ নারী। গত একবছরে শুধু নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাই হয়েছে ১৮ হাজারের বেশি। আর দেশের বিভিন্ন আদালতে এখনও দেড় লক্ষাধিক নারী নির্যাতন মামলা ঝুলে আছে। আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মোঃ আব্দুর রহিম বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি তৃনমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়েও নারী নেতৃত্ব বিরাজ করছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমরা নারী নেতৃত্বে অনেক এগিয়ে আছি। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানেও নারী পুরুষের সমতার কথা বলা আছে। নারীদের অবদানের স্বীকৃতি আমাদেরকে দিতে হবে। করোনা মোকাবেলায়ও নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি আরও বলেন, দেশের প্রতিটি থানায় নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা ডেস্ক রয়েছে। নারী পুরুষের সমতায় এগিয়ে যাবে দেশ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, মুখে আমরা অনেকেই অনেক কথা বলি কিন্তু বাস্তবে তা ধারণ করি না। নারী পুরুষ কোন আলাদা সত্ত্বা না। আমাদের ভাবতে আমরা সবাই মানুষ। তিনি বলেন, আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই নারীরা শুধু নারীদের দ্বারাই নির্যাতিত হয় না, নারীরা নারীদের দ্বারাও নির্যাতিত হয়। সরকারের নারী বান্ধব নীতিতে অনেক পরিবর্তণ হয়েছে। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে পারলেই নারীরা আরও বেশি ক্ষমতায়িত হবে। তাই নারীদের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে নারী পুরুষের সমতাকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা শাহনাজ বলেন, নারীরা আজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে, নারীরা আজ পুরুষদের সাথে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বে ৩জন নারী নেতৃত্বের মধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামও রয়েছে। যুগে যুগে নারীরা তাদের অবদান রেখেছে আজও পিছিয়ে নেই। তিনি আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, আমি মনে করি প্রতিদিনই নারী দিবস। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক পরিশ্রম করছেন। গত ৩০ বছরে আমরা তৃনমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়েও নারীদের নেতৃত্বে আছি। তারপরও নারীরা আজ অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আবার দেখা যায়, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল কাজে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের উপর সজাগ থাকার আহ্বান জানান। নারীরা তাদের মেধা ও শিক্ষা দিয়ে আরও এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করছি।
সনাক-চাঁদপুরের সভাপতি শাহানারা বেগম বলেন, একজন নারী মানে একজন মা। সে যে কতো বড় তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমিও একজন শিক্ষিত মা। কিস্তু আমার মা ছিলেন একজন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত মা। কিন্তু তিনি আমাকে এই জায়গায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন, নারী অধিকার আন্দোলন ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে আমরা এগিয়ে যাবো।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাফিয়া ইকবালের সভাপতিত্বে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার কবিতা ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন শারমিন আক্তার ও পবিত্র গীতা পাঠ করেন ইতি রাণী ঘোষ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জাতীয় মহিলা সংস্থা, চাঁদপুরের চেয়ারম্যান মাসুদা নূর খান, এলজিইডি’র সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী এইচ এম রাফিউল ইসলাম, ব্র্যাক সমন্বয়কারী জিয়াউর রহমান, চাঁদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর আয়েশা বেগম, উপজেলা মহিলা সংস্থার সভাপতি শাহেদা বেগম প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও রচনা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ”কেবলমাত্র নারী নের্তৃত্বই গড়তে পারে সমতার বিশ্ব” এই বিষয়ের উপর পক্ষ দল ছিলো চাঁদপুর সরকারি কলেজ ও বিপক্ষ দল ছিলো ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ। এছাড়াও আলোচনা সভায় চাঁদপুরের সাংবাদিকবৃন্দ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীবৃন্দ ও সনাক-চাঁদপুরের ইয়েস ও ইয়েস ফ্রেন্ডস গ্রুপের সদস্যবৃন্দ এবং টিআইবি কর্মীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উপর ধারণাপত্র সকলের মাঝে বিতরণ করা হয়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply