বালু উত্তোলন : সেলিম খানের আরও একটি মামলা উচ্চ আদালতে খারিজ

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হওয়ার পর আবারও বালু উত্তোলন শুরু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান। তিনি নানা কৌশলে আবারও বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে বিআইডবিøউটিএ চেয়ারম্যান ও হাইড্রোগ্রাফিক ডিভিশনের পরিচালকের প্রতি নির্দেশনা দিতে সেলিম খানের করা রিটটি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দু’ দিনের শুনানিশেষে ২৩ মে সোমবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মামলা শুনানী করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।
তিনি বলেন, তথ্য গোপন করে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান আবারও চাঁদপুর সদর উপজেলা ও হাইমচরের ৫টি মৌজায় বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার জন্য, নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে করার দাবিতে আবারও একটি রীট মামলা দায়ের করেন গত এপ্রিল মাসে। আদালত ২২ মে এবং ২৩ মে এ দু’ দিন শুনানী করেন।
তিনি বলেন, বালু উত্তোলন সংক্রান্ত আইনের বিধান আমরা আদালতকে দেখিয়েছি। আরেক মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে যে স্থগিতাদেশ আছে সেটিও আদালতের নজরে এনেছি। সব কিছু দেখানোর পর আদালত সন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের কোন বক্তব্যে আদালত সন্তুষ্ট হননি। তারা আমাদের বক্তব্যের কোন সদুত্তোরও দিতে পারেননি। সে কারণে আদালত সরাসরি মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন।
শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান বলেন, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে ৮৬ দশমিক ৩০ কিউবিক মিটার (৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট) বালু উত্তোলনে অনুমতি চেয়ে এর আগে তিনি রিট করেন। ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট তাঁকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। গত ৪ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন।
এসব তথ্য গোপন করে রিটটি করা হয়। এ ক্ষেত্রে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ৯–এর বিধিবিধানও অনুসরণ করা হয়নি। ২১টির মৌজার মধ্যে ওই ৪টি মৌজাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। একই বিষয় নিয়ে চলতি বছরেই আরেকটি রিট করন, তাতে অপর মৌজাটি উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্র কি এতই গরিব হয়ে গেছে যে উনার (সেলিম খান) টাকায় হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হবে। রিটটি সরাসরি খারিজের আরজি জানান তিনি।
অন্যদিকে সেলিম খানের পক্ষে আইনজীবী জাফর আলীম খান শুনানিতে বলেন, তথ্য গোপন করা হয়েছে বলা হচ্ছে, যা সঠিক নয়। আগের রিট ও এই রিটের বিষয়বস্তু এক নয়। একটি মৌজায় একাধিক হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ হতে পারে। মৌজায় একাধিক দাগ থাকে। ২০১০ ও ২০১৭ সালে দুটি রিটে পক্ষে আদেশ হয়। আদালত বলেন, একটি রিট খারিজ (রুল ডিসচার্জ) হয়েছে, অন্যটিতে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে দেখা যাচ্ছে। বালু উত্তোলনের অনুমতি কী দিয়েছে? যে দুটি রায়ের কথা বলছেন, তাতে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে-এমন বিষয় দেখা যাচ্ছে না।
একপর্যায়ে জাফর আলীম খান বলেন, হাইকোর্টের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আবেদন করে। দুটি আবেদনই খারিজ হয়েছে। সার্ভের জন্য টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। রয়্যালটি মানিও দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে গত ২২ এপ্রিল রিপ্রেজেন্টশন দেওয়া হলেও এর জবাব আসেনি। শুনানি নিয়ে আদালত রিট সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেন।
এর আগে ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। বালু তোলার অনুমতি বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের (লিভ টু আপিল) পরিপ্রেক্ষিতে ৪ এপ্রিল এ আদেশ দেন চেম্বার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।
২০১৫ সালে নৌপথ সচল করার কথা বলে রিট করেছিলেন চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর ল²ীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় চার বছর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় মেঘনার ডুবোচর থেকে ৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার বঞ্চিত হয়েছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে।
এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙনকবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডবিøউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
ওই চিঠির পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদফতর, বিআইডবিøউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply