বিশ্ব শিক্ষক দিবস : গুণগত শিক্ষা অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষকদের সম্মান জানাতে ১৯৯৫ সাল থেকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করে ইউনেস্কো। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবং শিক্ষণ-শিখণ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত সমস্যাসমূহ সমাধানের নিমিত্ত ইউনেস্কো এ দিবসটি পালনের উদ্যোগ গ্রহন করে। এবছরের শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘শিক্ষক-সংকটে নেতৃত্ব, নতুন করে ভবিষ্যতের ভাবনা’। ২০১৭ সালে এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘স্বাধীনভাবে পাঠদান, শিক্ষক হবেন ক্ষমতাবান’। ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘শিক্ষার অধিকার মানেই হচ্ছে একজন যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার অধিকার’। ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘তরুণ শিক্ষক, পেশার ভবিষ্যৎ’। বিশ্বের ১০০টি দেশে এবং এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল এর সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন এই দিবসটি পালন করে আসছে । তাছাড়া শিক্ষকদের মহৎ পেশার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বিশেষ ক্রোড়পত্র, সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপা হয়।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ কোভিড-১৯ এই সময় শিক্ষায় যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলা ও ভবিষ্যৎ বির্নিমাণে শিক্ষকগণকে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখিন হতে হবে সেগুলো হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতা-ভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। করোনার ফলে সারা বিশ্বে ৪ কোটি শিক্ষার্থী প্রাক-প্রাথমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রায় ২৫ কোটি শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনা, করোনার কারণে পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা, নতুন পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রমের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়া, করোনার আগের এবং করোনাকালীন শিক্ষার পরিবেশ আলাদা বিধায় নতুন করে শিক্ষণ শিখন পদ্ধতি ও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, পরিবর্তিত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে যেমন – গুগল মিট, জুম, হোয়াটস আপ ব্যবহার করে শ্রেণি-কার্যক্রম পরিচালনার করা ইত্যাদি অত্যাবশ্যকিয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য শিক্ষককদেরকে প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হবে।
আজকের শিক্ষার্থীই আগামী দিনের শিক্ষক। শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা হলো শিক্ষকতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশার লোকের বৈশিষ্ট্যগুলোও শ্রেষ্ঠ হওয়া আবশ্যক। একজন শিক্ষক অবশ্যই অনুকরণীয়, আদর্শিক জ্ঞানের অধিকারী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন, শালীন, মার্জিত হবেন, উত্তম আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন, কথা ও কাজে মিল রাখবেন, আদর্শ প্রচারে কৌশলী ও সাহসী হবেন, শিক্ষকতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে লালন করবেন, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন, ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসাসম্পন্ন হবেন, নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করবেন, ক্লাসে পড়ানোর জন্য আগেই প্রস্তুতি নেবেন, মেধা বিকাশে সহায়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, স্নেহ-মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন, সকল শিক্ষার্থীকে সমান চোখে রাখবেন, শিক্ষার্থীদের জ্ঞানলাভে উৎসাহিত করবেন, শাসন করবেন তবে প্রহার বা নির্মমতা প্রদর্শন করবেন না বরং দরদি মন নিয়ে তাদের ভুলগুলো শুধরে দেবেন, বিচক্ষণ হবেন, ছাত্রদের মন-মেজাজ পছন্দ-অপছন্দ ও কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন, মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখবেন, নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে কঠোর হবেন, সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হবেন এবং অভিভাবকের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করবেন।
ছোটবেলায় পড়েছি বাদশাহ আলমগীরের ছেলে একদিন তার ওস্তাদজির পায়ে পানি ঢালছিলেন, আর তার ওস্তাদজি হাত দিয়ে তার নিজের পা পরিষ্কার করছিলেন। এই দৃশ্যটি বাদশাহর দৃষ্টিগোচর হয়। পর দিন বাদশাহ তার ছেলের শিক্ষককে সালাম পাঠালেন এবং আবদারের সঙ্গে বললেন, ‘আমার ছেলে আপনার নিকট থেকে পরিপূর্ণ শিক্ষা পায়নি। আমি দেখেছি, আমার ছেলে তার ওস্তাদকে যথাযথ সম্মান দেয়া শেখেনি, আপনি কেন নিজ হাতে পা পরিষ্কার করবেন? আপনার ছাত্র এতটুকুও শেখেনি, ওস্তাদজির পা ধুয়ে-মুছে দেওয়া তার পবিত্র দায়িত্ব! সে এক হাতে পানি ঢালবে, অন্য হাতে পা পরিষ্কার করে দেবে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় আশুলিয়া জয়নাথ চক্রবর্তী হাই স্কুল নামের একটি স্কুল আছে। জয়নাথ চক্রবর্তী ছিলেন স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধান শিক্ষক। এ স্কুলে পড়ালেখা করে তাঁরই একজন ছাত্র একসময় সরকারের বড় পদে আসীন হয়েছিলেন। সে ছাত্র যখন গ্রামের বাড়িতে যেতেন, ঐ স্কুলের সামনে দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় ঐ ভদ্রলোক আমৃত্যু স্কুলের কাছে দিয়ে পায়ের জুতা হাতে নিয়ে স্কুলগেট অতিক্রম করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, গেটটিতে তার শিক্ষকের নাম লেখা রয়েছে। এ নামের প্রতি সম্মান জানাতেই তিনি পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিতেন।
শেখ সাদি প্রার্থনা করেছেন, ‘হে খোদা, তুমি আমাকে আদব শিক্ষা দাও, যেহেতু বেয়াদব তোমার অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত।’ রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন করো। কোনো ব্যক্তি জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।’ ‘অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদব অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।’ হজরত লোকমান (আ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি আদব কোথা থেকে শিখেছেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘বেয়াদব থেকে। কেননা তারা যা করে আমি তা করি না।’ তাই কবিতার ভাষায় বলা যায়―
‘সর্বজন সর্বক্ষণ চলে যেই পথে,
তৃণগুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোনো মতে।’
আমি বেশ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়েছিলেন। দর্শক সারিতে সামনে বসা ছিলেন তাঁর সাবসিডিয়ারি বিষয় শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন। মতবিনিময় সভাস্থলে শেখ হাসিনা এসে ইতস্ততবোধ করছিলেন, তিনি কিভাবে তাঁর জন্য সামনে রাখা বড় চেয়ারটিতে বসবেন। এ জন্য তিনি অধ্যাপক সেনের অনুমতি চাইলেন এবং তারপর আসন গ্রহণ করলেন। তাঁর বক্তৃতার শুরুতেও উল্লেখ করলেন, স্যারের সামনে কথা বলতে তিনি জড়তা বোধ করছেন। দেখা গেছে সভামঞ্চে যখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান থাকতেন কিংবা অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বা তাঁর কোনো শিক্ষক বা শিক্ষকতুল্য কেউ থাকেন তখন তিনি তাঁদের হাত তুলে সালাম জানিয়ে তারপর নির্ধারিত চেয়ারে বসতেন। এটাই হচ্ছে আদব-কায়দা বা নম্র-ভদ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল রাজনীতি, কিম্বা শিক্ষাঙ্গণ অথবা সমাজের যেদিকেই তাকাই না কেন সব জায়গায়ই আদব-কায়দার অনুপস্থিতি চোখে পড়ে।
বেশির ভাগ শিক্ষক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। যে পেশায় থাকলে পশু সমতুল্য শিশুকে মানুষ বানানো যায়। শিশুর মধ্যে মানসম্মান বোধ জাগ্রত করা যায়। শিক্ষকরা কতটা নিঃস্বার্থ হতে পারেন তা নিচের উদাহরণ থেকে বুঝতে পারবেন। কোনো শিক্ষক যদি এসএসসি পাস হয়ে থাকেন, তিনি সর্বক্ষণ দোয়া করেন তার ছাত্ররা যেন দুনিয়ার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। আবার কোনো শিক্ষক যদি তৃতীয় বিভাগে পাস হয়ে থাকেন, তিনি সব সময় কামনা করেন তাঁর ছাত্ররা যেন প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারে। অন্য পেশায় তা সচরাচর দেখা যায় না।
শিক্ষার্থীকে সৎ, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকগণ নিজেদের চালচলন, আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা ও চরিত্রে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেওয়ার আগে শিক্ষককে সৎ, আদর্শবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে আর তা গ্রহণ করতে হলে সৎ, বিশ্বস্ত, গ্রহণযোগ্য ও গুণী ব্যক্তিকে নির্বাচন করা আবশ্যক। উপদেশের প্রভাব পরোক্ষ, অন্যদিকে অনুসরণের প্রভাব প্রত্যক্ষ। সমাজ-ব্যবস্থায় মুল্যবোধ জাগ্রত করতে চাইলে নিজেরা নিয়ম-কানুন, শিষ্টাচার, আদবকায়দা ইত্যাদি মান্য করার মাধ্যমে অন্যকে মানাতে পারলে তা টেকসই ও প্রয়োগযোগ্য হবে।
শিক্ষক যখন ছাত্রকে পড়ান―তিনি আসলে নিজেকে ছাত্রের সেবক মনে করেন। এটা ঠিক যে, কখনো কখনো দায়িত্বের কারণে ছাত্রকে শাসন করেন, কখনো কখনো শাস্তিও দিয়ে থাকেন। যেমন উস্তাদ সাগরেদকে শাস্তি দেয়, পিতা সন্তানকে শাস্তি দেয়। এ শাসন ও শাস্তি দুটোই সেবা। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলকে ভাবতে হবে, কর্তব্যের খাতিরে এই কাজটি করতে হচ্ছে। এটা ভাবা ঠিক নয় যে আমি বড়, অন্যরা ছোট। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাই তারা জীবনের শুরুতেই তাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও মা-বাবাকে অনুকরণ শুরু করে। শিক্ষার্থীরা প্রধানত চারটি উপায় শিখে যেমন- শুনে শিখে, দেখে শিখে, পড়ে শিখে এবং কাজ করে শিখে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানবসন্তান সবচেয়ে বেশি শেখে দেখে এবং কাজ ক’রে। এই শেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা, কাজ করার জন্য নিজকে উপযোগী করে তোলা, সমাজের অন্য সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলার যোগ্যতা অর্জন করা এবং সমাজে অনুকরণীয় একজন হওয়া। পিতা-মাতা যে কাজটি নিজেরা করে সন্তানদের দেখান, তারাও সেটা সহজে গ্রহণ করে। মা-বাবা এবং পরিবারের সদস্যরাই শিশুর আচার-আচরণ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই শিশুদের কাছ থেকে সুন্দর আচরণ প্রত্যাশা করলে তাদের সঙ্গে সুন্দরভাবেই আচরণ করতে হবে। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শিশুর বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ রয়েছে, ‘শিশুকে সুন্দর আচরণ শেখাতে হলে তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে, পরিবার থেকেই শেখাতে হবে বড়দের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয় এবং ছোটদের কিভাবে ভালোবাসতে হয়। বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের ভালোবাসার শিক্ষা বাস্তবে করে দেখাতে হবে। এতে শিশু খুব সহজেই তা গ্রহণ করবে। শিশুরা কোনো ভুল করলে তাদেরকে প্রথমে বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে বকা দিতে হবে। তবে অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করা অনুচিত। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করলে তারা পিতা-মাতার নিকট কোনো কিছু লুকাবে না। শিশুরা বাইরে খেলতে গেলে শিশু কার সঙ্গে মেলামেশা করছে সেদিকে খেয়াল রাখা এবং শিশুর আচার-আচরণে খারাপ কোনো পরিবর্তন দেখলে তাকে শোধরানো উচিত। শিশুর সঙ্গে সব সময় সত্য কথা বলতে হবে। শিশুরা কোন ভুল স্বীকার করলে ভবিষ্যতে যেন এমন কাজ না করে সে বিষয়ে সাবধান করে দিতে হবে। দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় বেছে নিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করুন, আনন্দ করুন, মোটকথা সম্পূর্ণ মনোযোগ তাদের দিকে দিন। ফলে শিশুরা বুঝবে আপনার কাছে তার গুরুত্ব আছে। শিশুকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে তার সুন্দর ব্যবহার ও সৎ চরিত্র বিকাশে সহায়তা করা উচিত। শিশুকে গড়তে গিয়ে যে সময়টি শিক্ষক ও মা-বাবা যে সময়টুকু ব্যয় করবেন তা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়।
ইউনেস্কো যে থিম নিয়ে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২০’ পালন করছে তা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন, কার্যকারিতা ও কার্যক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনাকালীন সময়টাতে শিক্ষা সংকট মোকাবেলায় শিক্ষকদের নেতৃত্ব আবশ্যক। তাই শিক্ষকদের নেতৃত্ব বিকাশে নিম্মোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। করোনার কারণে বর্তমান শিক্ষার প্রায় অধিকাংশই চলছে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেকেই জুমে, গুগল মিটে ক্লাস নিচ্ছেন। সরাসরি শ্রেণি-কার্যক্রম এবং দূরশিক্ষণ শিক্ষা-কার্যক্রমে পার্থক্য রয়েছে। দূরশিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম। দূরশিক্ষণ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে শিক্ষণ-শিখানো পদ্ধতি কার্যকরী করার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষককদের জন্য সামনে যে বিষয়টি খুবই চ্যালেঞ্জিং তা হলো বিদ্যালয় খোলা ও সেশন শুরু করা।
শিক্ষণে শিক্ষকের ভূমিকা দুইভাবে সম্পন্ন হতে পারে। একটি হলো সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এবং অপরটি হলো ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান। শ্রেণিকক্ষের নেতৃত্ব শিক্ষার্থী ও শিক্ষককের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। সেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মেধা, যোগ্যতা ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, শিক্ষণ-শিখনের পদ্ধতি, শিক্ষাক্রম, শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা, ধারাবাহিক শিখন, শিখনের মূল্যায়ন, বিভিন্ন বিষয় নির্ধারণ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন, কার্যকরী ও উদ্ভাবনীয় শিক্ষণ-শিখনে শিক্ষক নেতৃত্ব দান ইত্যাদি। শিক্ষণে প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিচালনা-কৌশল, অনলাইন শিখন পরিচালনার নিমিত্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষককের ভূমিকা অগ্রগণ্য হতে হবে। তাছাড়া দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষণ-শিখন কার্যকরী করা শিক্ষকদেরই দায়িত্ব।
একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষকদেরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নানা ধরনের কাজ করতে হয়। দূরশিক্ষন শিক্ষণ-শিখনে বিদ্যালয়ের নিজস্ব পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করতে, শিখন পদ্ধতি নির্বাচন করতে, কোন সফটওয়্যার বিদ্যালয়ের জন্য উপযোগী করতে শিক্ষকগণকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাছাড়া অনলাইনে বিদ্যালয় পরিচালনায় শ্রেণির রুটিন, পাঠদান পদ্ধতি এবং শিখন উপকরণ নির্বাচনেও প্রধান শিক্ষকের পাশাপাশি সকল শিক্ষক সমানভাবে ভূমিকা রাখতে হয়। অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ অন্য যেসকল শিক্ষক এই দূরশিক্ষণের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না তাঁদের সহযোগিতা করতে পারেন। শিক্ষকগণ প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে অনলাইনে আনার এই প্রচেষ্টায় সবাইকে সমানভাবে ভূমিকা রাখতে হয়। বাংলাদেশে এখনো শিক্ষকতাকে ‘ব্রত‘ হিসেবে দেখতে চায়। তাই রাষ্ট্রের দেয়া বাজেটে শিক্ষকতা পেশায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দেশে শিক্ষকের মর্যাদা কম। রাষ্ট্র চায় শিক্ষকরা কোনো রকমে খেয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্ব পালন করুক। বাংলাদেশের শিক্ষকরা তা করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষকরা যেমনই থাকুক, প্রতিবছর অসাধারণ সব প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ উদযাপিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সর্বমোট ১৭টি, এর সবগুলোই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুনগত শিক্ষা, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্ছস্যপূর্ণ। সমাজের সাথে শিক্ষাবিদদের যোগাযোগ অপরিহার্য। শিক্ষকগণ যদি নিজ নিজ দক্ষতা ও যোগ্যতা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা স্থির করে এগিয়ে যান তাহলে করোনার সময়ে সৃষ্ট শিক্ষাসংকট কেটে গিয়ে ভবিষ্যত পুনঃনির্মাণ কাজটি কঠিন হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষকরাই হবেন সম্মুখ যোদ্ধা । আসুন আমরা সবাই মিলে শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা ও যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করি এবং একটি সুখী, সমৃদ্ধ, মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, নায়েম, ঢাকা ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply