মধুমাস

মাহাবুবুর রহমান সেলিম ::
বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চিরাচরিত সাংস্কৃতিক জীবনধারা একটি ঐতিহাসিক আদর্শের ফসল। চিরায়ত বাঙালির বারো মাসে তেরো পাবন। ষড়ঋতুর এই বৈচিত্র্যময় অপরূপ দেশ। এবং প্রত্যেক ঋতুর রয়েছে আনন্দ উজ্জ্বল ভরা একএকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। গ্রীষ্মের তাপ বষার ঝরঝরে বৃষ্টি বাদলের ধারা,শরতের ঝলমলে রুপালী আকাশ। হেমন্তের ঐশ্বর্য মাঠভরা ফসল, শীতের শীতল হাওয়া, ভোরের শিক্ত শিশির আর বসন্তে ফুলে ভরা বাগান।
প্রকৃতির এই অদ্ভুত প্রাণচঞ্চলা, প্রাণভরা মাটি অতি সুফলা। তেমনিভাবে এক সময় আসে অপুর্বক্ষনে রৌদ্রস্নাত ভোর অপরুপে মধুমাশ নিঝর উতলা বাতাসে।
পাখীর কলতান, ফলের সমারোহ, ফলের গন্ধে মৌ মৌ। বাগানে পাখীর আনাগোনা কবির কবিতায় মধু সুখ, হৃদয়ে ফুল ফুটে হীনমন্যতা দূর করে। ফুলে ফলে রসে মধুময় মধুমাস। রক্তিম সূর্য এদিন নবরূপে সজ্জিত করে প্রকৃতিকে। দিনক্ষণ প্রতিক্ষণ জগৎজুড়ে মায়ার বন্ধন। গায়কের গলায় উপচে পড়ে মধুর রসে সুমধুর গান। গাছে গাছে রসে ভরা ফল নির্বিঘ্নে হয় ফলবতী। সবুজ প্রকৃতির মাঝে পাখিরা দলবেঁধে উড়ে আপন সাজে। মন মুগ্ধকর বিকেল নীলাভ আকাশ, দূরের সবুজ ফলের বাগান। আনন্দ ভরা মানুষের চকচকে চোখ অনুকূল সুখের হাওয়ায়। মধুমাস মধু মমতায় উদ্ভাসিত পুষ্টিগুণে ভরপুর ফলের প্রাচুর্যে বিস্তৃত আপন ভূমি। মাছে ভাতে বাঙালি রসনাতৃপ্তির মিষ্টি ফলে আপ্লুত। মৌসুমি ফলে রঙিন লোকালয়। আলোয় ঝলমলে রোদে নব আনন্দে মেতে উঠে প্রকৃতি। উৎসব মুখর এই মধুমাস। মাধুর্যপূর্ণ ফলময় ঐশয্য ভরা প্রকৃতির এক অভূতপূর্ব বিন্যাস।
‘সংগীতের গভীরে রসের সুরেলা প্রাণ,
রসে ভরা মধুময় মধুমাসের আহ্বান।’
মধুমাস বলতে যদিও চৈত্র মাস কে বুঝায়। অনেক কবিরা ফাল্গুন-চৈত্রে কোকিল ডাকে বলে সেই সময়টা ধরে নিয়েছে বসন্ত এবং মধুমাস। কিন্তু জৈষ্ঠ্য মাস ফলের গন্দে বাংলার পথঘাট বাজার হাট মৌ মৌ করে। বাজার পরিপূর্ণ ফলে ফলে। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, আনারস ও আরও নানান ফল। তাই পক্ষান্তরে জ্যৈষ্ঠ মাসই মধুমাস। মিষ্টি ফলের রসে ভরা অতিপ্রিয় মধুমাস। জ্যৈষ্ঠ মাস নিয়ে বহু কিছু লিখতে গেলে মধুমাস বিশেষণটি এসে যায়। বাতাস বহে দেহ স্নিগ্ধকর। পেকে উঠা লিচু গাছ ঘিরে দিনের আলোতে পাখী আর রাতের অন্ধকারে ঝাকে ঝাকে বাঁদুরের আনাগোনা কোলাহল। তাইতো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একসময় লিখেছেন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। এমনি এক এক সূত্র ধরে পরবর্তীতে মিডিয়ার কারণে নবপ্রজন্ম জ্যৈষ্ঠ মাসকেই মধু মাস হিসেবে বিবেচনায় আনে। যা অনেকটা জোরদার হয়েছে আশির দশকে। জ্ষ্ঠ্যৈ নক্ষত্রের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং চিরায়ত ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা একটি ঐতিহাসিক আদর্শের ফসল। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল এই সময় থেকে পাওয়া যায়। ঋতুরঙ্গময়ী অপরূপ ছন্দময়ী বিচিত্র রূপের আমাদের এই বাংলা। পাগল করা মধুর অন্তহীন হাসি। বিচিত্র ভৌগলিক অবস্থান, সাগর পর্বত বেষ্টিত। বছরের ছয় ঋতুর অনন্য বৈশিষ্ট্যের যেখানে আগমন ঘটে। কালের অনন্ত যাত্রা পথে বদলায় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে। এমনই এক জৈষ্ঠ্যের রোদ্র স্নাত সকাল। গরম মাখা দুপুর ক্ষুব্ধ সূয্য,খরতপ্ত ধরিত্রী তৃষ্ণার্থ সব প্রান্তর।
গাছে ঝুলছে কাঁচা পাকা আম। বাতাস ভারী টসটসে ফলের অকৃত্রিম গন্ধে। প্রাকৃতিক দৃশ্যপট অভূতপূর্ব এবং আশ্চর্যজনক। ফলের বাহার আম,কাঁঠাল, লিচু, জাম সহ তরমুজ, আনারস, লটকন, গোলাপ জাম, জামরুল, শরীফল এবং আতাফল। আমের মধ্যে অতি সুস্বাদু ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম রুপালি সহ আরো অনেক। চিরায়িত বাঙালি এবং বাঙালি কবি তাই অতি মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন, পাকা আমের মধুর রসে রঙিন করি মুখ। আমাদের সিলেট জেলায় জৈষ্ঠ্যকে অর্থাৎ মধুমাস কে কেন্দ্র করে প্রচলিত প্রথা আছে। বিয়ের পর মেয়েদের পিত্রালয় থেকে ফলের ঝুড়ি সঙ্গে খই, মুড়ি, দই সহ অর্থাৎ আম্বকচি পাঠানোর রেওয়াজ, যা এখনও প্রচলিত আছে।
মিষ্টি ফলের রসে ভরা মধুমাস। রসালো স্পন্দন আত্মার নিবিড় সম্পর্ক, মনের সব অন্ধকার দূর করে আলোর ছড়াছড়ি প্রকৃতির মাধুর্যতায়। নীরব দুপুর সোনা ঝরা গ্রামের মেঠো পথ। যেন গ্রীস্মের শেষপ্রান্তে পাকা ফলের রসে টইটুম্বুর রসালো মাস। ঋতুরঙ্গময় রূপে ভরা আমাদের এই চারনভুমি। ঋতু পরিবর্তনের অপরূপ পালাবদল। চাকচিক্য বর্ণ বিচিত্র বৈচিত্র্যময় বিশেষ ধারাপথে ঋতুর অভিভূত পথ চলা। অনন্য বৈশিষ্ট্য অনাবিল সৌন্দর্যে এক ঋতু থেকে অপরটি সম্পূর্ণ আলাদা। সেই ধারাবাহিকতায় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাসে হয় গ্ৰীষ্মকাল, আষাঢ় শ্রাবণে বর্ষা, ভাদ্র-আশ্বিন হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘে শীত কাল এবং সর্বোপরি ফাল্গুন-চৈত্র মিলে হয় বসন্তকাল। তবে এখন আলোচ্যে আসে জৈষ্ঠ্যকে নিয়ে। এ মাসে রস ফলের প্রাচুর্য, মধুময় দিকময়। চারিদিকে যখন তাপদাহ তৃষ্ণার্ত জনজীবন,জলবিহীন পুকুর, খাল, বিল চৌচির নির্জীব। তখন নতুন সাজে ফলের ডালা ভরে আম, জাম, লিচু কাঁঠাল, তরমুজ, জামরুদ সহ আরো অনেক রসালো ফলে সমাদৃত।
স্বাতন্ত্র্যের অনুপম রূপসজ্জায়।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply