আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

মারুফা সুলতানা খান হীরামনি ::
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ধাপগুলোর অন্যতম প্রধান ধাপ হলো সাক্ষরতা অর্জন। এটি একটি মৌলিক, মানবীয় অধিকার এবং সকল শিক্ষার ভিত্তি। সাক্ষরতার উপযুক্ত ব্যবহার ব্যক্তির জ্ঞানার্জনের দ্বার উন্মুক্ত করে, জীবন যাপনের জ্ঞান ও কৌশল অর্জন করতে সাহায্য করে যার দরুণ ব্যক্তি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক কাজে নিজেকে অধিকতর সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে পারে যা উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, যার যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। ১৭ নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সে বছরই (৮-১৯) সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা হয়ে আসছে।


আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল লক্ষ্য সবার জন্য সাক্ষরতা কার্যক্রম বাস্তবায়নে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। UNESCO ঘোষিত এ বছরের সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো “Literacy teaching and learning in the COVID-19 crisis and beyond with a focus on the role of educators and changing pedagogies” যার বাংলা রুপ হলো “কোভিড-১৯ সংকট : সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল এবং শিক্ষাবিদদের ভূমিকা”।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা ডিজিটাল উপায়ে নিবারণের চেষ্টা করা হলেও এর ফলাফল মূলত খারাপই হবে তবে এই অবস্থার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছুটা হলেও এগিয়ে গিয়েছেন। শিখণ ও শেখানো কৌশলে এসেছে নানা পরিবর্তন। আমার ২য় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে অনলাইনে তার বিদ্যালয়ের ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। সে অনলাইন ক্লাস উপভোগ করে না। সরাসরি স্কুলে গিয়ে ক্লাস করায় তার প্রবল আগ্রহ। সে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো, তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেও তার অনলাইনে ক্লাস করতে হবে কী না, যদি তাই হয় তাহলে সে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতে চায় না। তবে এটা ঠিক অনলাইনে ক্লাস করার কারনে শিক্ষার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাটুকু না পেলেও অন্তত পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে না, এটাই ভরসাস্থল। শিক্ষকদের এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রয়েছে। তারা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাপারটিকে তাদের আয়ত্বে এনেছেন এবং একে উপভোগ্য করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে শিক্ষাবিদগণও এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন এবং পরবর্তীতে শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় মহামারী বা এই জাতীয় প্রতিবন্ধকতাগুলো বিবেচনায় আনতে পারেন।

অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক ইত্যাদিসহ নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হলো সাক্ষরতা অর্জন করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সাক্ষরতার সংজ্ঞায় ভিন্নতা থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো সার্বজনীন একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। তখন শুধু কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। পরবর্তীতে প্রায় প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে এবং ১৯৯৩ সালের একটি সংজ্ঞায় ব্যক্তিকে সাক্ষর হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। যথা- ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে। তবে এই সংজ্ঞাটিও এখন পরিবর্তনের দাবি রাখে কেননা বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার জানা অতীব জরুরি ।
মহামারী কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের জন্য বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এতদস্বত্তেও সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, ২০২০ উদযাপন উপলক্ষে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭ শতাংশ এবং একে বৃদ্ধি করতে নানা ধরণের পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতিতে দিবসটির বিভিন্ন কার্যক্রম স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সীমিত পরিসরে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ ( এসডিজি ) পূরণের জন্য সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষা বিষয়ে এসডিজি’র ৪ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে- অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সকলের জন্য শেখার সুযোগ নিশ্চিতকরণ। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল ( এমডিজি )-র লক্ষ্যমাত্রা ২ অর্থাৎ সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তাই আশা করা যায় এসডিজি’র শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও বাংলাদেশ অনুরুপ সাফল্য ধরে রাখবে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে। তাছাড়া সরকার এসডিজি এবং জাতীয় অঙ্গীকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ( ২০১৬-২০২০ ) প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ৪র্থ লক্ষ্যে সাক্ষরতা বিস্তার, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশকে প্রযুক্তিনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে এবং রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে সরকার নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বদ্ধ পরিকর। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে ৬৪ টি জেলায় ৫০২৫ টি কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করে নব্য সাক্ষরদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করছে। তাছাড়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, উপশহরে বিদ্যালয় স্থাপন, কমিউনিটি শিক্ষার ব্যবস্থাকরণ, খাদ্যের জন্য শিক্ষা কর্মসূচি, উপবৃত্তির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি, বিদ্যালয় ত্যাগের প্রবণতা কমানো, মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ, মেয়েদের উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি নানা রকম কার্যাবলি চলমান আছে এবং পরস্থিতি বিবেচনায় আরও নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে এই প্রত্যাশা করছি, আজকের এই সাক্ষরতা দিবসে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবো এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।
মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর, ঢাকা

শেয়ার করুন

Leave a Reply