এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার ঢাকায়, কী তাঁর কাজ

চাঁদপুর প্রতিদিন ডেস্ক :

বাংলাদেশের বুশরা আফরিন ঢাকা শহরের চিফ হিট অফিসার (সিএইচও) পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এশিয়ার প্রথম সিএইচও তিনি। আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অ্যার্ডিয়ান আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশনের রেজিলিয়েন্স সেন্টার তাঁকে এই পদে নিয়োগ দিয়েছে।

সমাজকর্মী আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে। বাংলাদেশে পোশাককর্মীদের অধিকার রক্ষা ও টেকসই পোশাক রপ্তানি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তাঁর বাবাও একজন সফল রপ্তানিমুখী পোশাক ব্যবসায়ী।

আফরিনের নেতৃত্বে গার্মেন্টস শিল্প কারখানার মেঝের তাপ কমানোর জন্য একটি টাস্কফোর্স তৈরি করা হয়েছিল। তিনি মা পোশাককর্মীদের জন্য কারখানার অবকাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছেন। এর মধ্য রয়েছে শিশুদের দুগ্ধদানের জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি ও ডে-কেয়ারের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

আফরিন ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইন প্রণয়নে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। আফরিন কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও ড্রামা বিষয়ে স্নাতক।

অ্যার্ডিয়ান আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় শহরে সিএইচও নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি, সিয়েরা লিওনের ফ্রি টাউন, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মন্টেরি এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। তাঁরা সবাই নারী।

ফাউন্ডেশনের রেজিলিয়েন্স সেন্টারই প্রথম পদের ধারণা আনে। তাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্য ১০০ কোটি মানুষকে দাবদাহমুক্ত করার। এই ধারণা পছন্দ হওয়ায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস নগর কর্তৃপক্ষও সিএইচও নিয়োগ দিয়েছে। এর জন্য আলাদা তহবিলও বরাদ্দ করেছে তারা।

গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বুশরা আফরিন বলেন, ‘এই ঢাকা শহরেই আমার জন্ম। অসহ্য গরমের কারণে আজ তাকে যেন আর চিনতে পারছি না। ঢাকা বসবাসের অযোগ্য জায়গা—এই কথাটিই ঢাকার প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে।’

বর্তমানে ঢাকা এশিয়ার সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহের একটি শহর। এই শহরের মাসিক গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উচ্চ আর্দ্রতার কারণে কখনো কখনো তা ৪০ ডিগ্রিতেও পৌঁছায়। গত মাসেই শহরের তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে উঠেছিল। যা ৬ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্রমাগত জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি এই শহরকে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে।

২০২১ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বছর দাবদাহ থাকবে এমন শহর হতে চলেছে ঢাকা।

ঢাকা শহরের সিএইচও নিয়োগ পাওয়ার পর বুশরা আফরিন বলেন, ‘আমি সবার জন্য কাজ করতে চাই। তবে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে।’

বুশরা বলেন, দাবদাহ মানুষের জন্য এক নীরব ও ভয়ানক শত্রু। অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এখন দাবদাহ। এর শিকার হচ্ছেন বৃদ্ধ, কিশোর, দরিদ্র ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তরা।

বিভিন্ন শহর আরশট-রকফেলারের সদস্য হচ্ছে শুধু দাবদাহ রোধে তাদের উদ্যোগের জন্য নয়, বরং বিভিন্ন শহর ও স্থানীয় সরকার তাদের নতুন এই ধারণা গ্রহণ করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তাদেরই একটি। সিএইচওরা তাঁদের পরিকল্পনাগুলোকে বিভিন্ন শহরে বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন।

বুশরা আফরিন বিশ্বের বিভিন্ন শহরের সিএইচওদের কাছ থেকে শিখতে আগ্রহী। তিনি বলেছেন, ‘আমি তাঁদের সম্পর্কে জানতে ও একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি। তাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ; যা আমাকে আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে সাহায্য করবে।’

আরশট-রকের ডিরেক্টর ও সিএইচও প্রোগ্রামের মূল পরিকল্পনাকারী ক্যাথি বগম্যান ম্যাকলিওড ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ‘এই পদের জন্য নারীদের নির্বাচিত করা হয়েছে কারণ, দাবদাহের শিকারের সিংহভাগই তাঁরা।’

২০৫০ সালের মধ্য পৃথিবীর উষ্ণতম দিনের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে এক সমীক্ষায় আশঙ্কা করা হয়েছে। আর এর ভুক্তভোগী হবে নারীরা। দাবদাহ অসমভাবে শুধু নারীদের স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলে না, অর্থনীতিকেও সংকটে ফেলে। কারণ, নারীরা বিশ্ব অর্থনীতির অস্বীকৃত মেরুদণ্ড। সারা বিশ্বেই নারীরা গৃহস্থালি ও সন্তান দেখাশোনা করেন। যার পারিশ্রমিক দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্ত হয় না।

বগম্যান ম্যাকলিওড আরও বলেন, ‘নারীদের এসব পদে নিয়োগ দেওয়াই যৌক্তিক। এটি সময়ের প্রেক্ষাপটে সেরা বিনিয়োগ।’

বিশ্বের বড় শহরগুলোর দিন দিন আবহাওয়া ও পরিবেশের হুমকির মুখে পড়ছে। ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বড় শহর ঢাকাও এর মধ্য রয়েছে। ঢাকা শহরে ঘনবসতি হওয়ায় এখানে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা হতে পারে।

এ বিষয়ে বুশরা আফরিন বলেন, ‘আমি জানি না, ঢাকার অবস্থাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে মানুষ আসলে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। দাবদাহ এত বেশি যে প্রচুর ঘামলেও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসবে না। ঢাকায় বাইরে বের হওয়াটা দিন দিন আরও প্রতিকূল হয়ে উঠছে।’

বুশরার ভাষায়, ঢাকায় গত মাসে দাবদাহের কারণে বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ঢাকার বাতাসে এখন আরও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দুই হাজারের অধিক বেকার মানুষ ঢাকায় আসেন জীবিকার জন্য। এঁদের অধিকাংশই কৃষক বা জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ। কারণ, তাঁরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে নিজ এলাকায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফিট উঁচুতে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি ও সাইক্লোনের আঘাতে দেশের হাজার হাজার একর ভূখণ্ড এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে।

আফরিন জানান, দেশের জনসংখ্যার বিরাট এক অংশ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পানীয় জলের সংকটে রয়েছে। এ থেকে বের হতে তাঁদের নিয়ে দাবদাহ রোধেও কাজ করতে হবে। ঢাকা শহরে ভবনগুলোতে অতিরিক্ত পরিমাণে ধাতব বস্তু ব্যবহার করা হয়। যা বাড়িগুলো বসবাসের অযোগ্য করে তোলে। দেশে সর্বশেষ দাবদাহ এর প্রমাণ। এ সময় বাড়িগুলো জ্বলন্ত চুলার মতো উষ্ণ হয়ে পড়েছিল, অধিকাংশ মানুষ রাতে ঘুমাতে পারেনি।

দেশের বেশির ভাগ মানুষের এসি ব্যবহারের সাধ্য নেই। তাঁদের ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার সুযোগও নেই। তাঁরা ওয়াসার যেই পানি পান সেটিও সেদ্ধ পানির মতো গরম। এটা দেশের গণস্বাস্থ্য সংকট। মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যোগ করেন বুশরা আফরিন।

মায়ামিতে নিযুক্ত পৃথিবীর প্রথম সিএইচও জেন গিলবার্ট বিভিন্ন ভাষাভাষী খামারকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছেন। এ ছাড়া হ্যারিকেন প্রস্তুতির জন্য রাস্তার পাশে বিলবোর্ড বসাচ্ছেন ও স্থানীয় রেডিওতে দাবদাহের কারণে হওয়া রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন।

সান্তিয়াগোর সিএইচও ক্রিস্টিনা হুইডোব্রো আঞ্চলিক গভর্নরের ২০ লাখ ডলারের একটি প্রকল্পে শহরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির তদারকি করছেন।

ফ্রি টাউনের সিএইচও ইউজেনিয়া কার্গবো বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো স্টলের ছাউনি। তিনি তাঁদের সেটি সরবরাহ করেছেন। এখন এসব ছাউনি ব্যবসায়ীদের ও তাঁদের পণ্যগুলোকে দাবদাহ থেকে রক্ষা করছে।

বুশরা আফরিনও ঢাকায় দাবদাহ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেই মনোনিবেশ করছেন। পাশাপাশি পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন। তাঁদের লক্ষ্য দাবদাহে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের খুঁজে বের করা ও তাঁদের নিয়ে কাজ করা।

এ জন্য বুশরা আফরিন বলেছেন, ‘আমি দাবদাহ নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ। ঢাকা শহরের দাবদাহ নিয়ে কাজ করার জন্য এটি উপযুক্ত সময়। কেননা, অসংখ্য মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমি শুধু নিজের মেয়ের জন্য নয়, সব শিশুর জন্য একটি সুন্দর ও ন্যায্য ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চাই।’

তথ্যসূত্র: দৈনিক আজকের পত্রিকা অনলাইন
ছবি: সংগৃহীত

শেয়ার করুন