জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলন

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান ::
প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। ১লা মার্চ, অপরাহ্ন বেলা ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের বিশেষ অনুষ্ঠানে পঠিত প্রেসিডেন্টের বিবৃতিতে বলা হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩রা মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন বিকালে পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সংক্ষিপ্ত সভা শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। ২রা মার্চের দৈনিক ইত্তেফাকে সে সাংবাদিক সম্মেলনের বিষয়বস্তু এভাবে তুলে ধরা হয়-
শেখ মুজিব বলেন-
আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন : শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করিতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রি পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য বাংলা দেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো এবং জনাব কাইয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজী ছিলেন।
গতকাল (সোমবার) বিকালে পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সংক্ষিপ্ত সভা শেষে আকস্মিকভাবে আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ-প্রধান আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় এবং আগামীকাল (বুধবার) ৩রা মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সর্বাত্মক হরতাল পালনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসাবে আগামী ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে। শেখ মুজিব বলেন, এই জনসভায় তিনি পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করিবে।
হিংসাত্মক পথে নয়
জনগণকে যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকিতে আহ্বান জানাইয়া শেখ মুজিব হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ হইতে বিরত থাকিতে পরামর্শ দেন। শেখ মুজিব বলেন : আমরা গণতান্ত্রিক দল এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাসী এবং আমরা শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাইয়া যাইব।
‘আমার সহিত আলোচনা হয় নাই’
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার পূর্বে তাঁহার সঙ্গে কোন আলোচনা করা হইয়াছে কি-না, এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন : আমার সহিত আলোচনা হয় নাই।
‘ওঁদেরকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে বলি’
পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা চাহিবেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের জনগণকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আহ্বান জানাইবেন। তাঁহারা রুখিয়া দাঁড়াইবেন কিনা, তাহা তাহাদের উপরই নির্ভর করে।
‘অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করিব’
অপরাপর রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করিবেন কি-না এইমর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন।
নিজ দলের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করার আশংকা করেন কিনা এইমর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন: আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতে প্রস্তুত। জনগণ আমার সঙ্গে আছেন। আমরা ভালই আশা করি এবং চরম অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি।
নতুন দিনের নতুন শপথ
আওয়ামী লীগ-প্রধান বলেন যে, তিনি ৭ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচী ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি বলেন : আমার দল আমাকে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা দিয়াছে। তিনি বলেন যে, পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যগণ গতকাল গত ৩রা জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে যে শপথ গ্রহণ করিয়াছিলেন উহার পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন।
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন : ৩রা জানুয়ারী আওয়ামী লীগ সদস্যগণ ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার শপথ নিয়াছিলেন। জনাব শেখ মুজিব বলেন : আজ সদস্যগণ পাকিস্তানেই জনগণের মুক্তির শপথ নিয়াছেন।
‘ওঁরাও এদেশেরই সন্তান’
বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালীদের কি হইবে এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন : তাঁহারা এই মাটিরই সন্তান। তাঁহাদিগকে এখানকার জনগণের সাথে মিশিয়া যাইতে হইবে।
শেখ মুজিব বলেন : আমরা গণতান্ত্রিক দল। আমরা গণতান্ত্রিক অহিংস-অসহযোগ নীতি অনুসরণ করিব।
আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হইয়াছি এবং শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য আমরা তাদের নিকট দায়ী রহিয়াছি।
জনাব ভুট্টোর বিবৃতির উল্লেখ করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, জনাব ভুট্টো আইন ও শৃংখলা নিজের হাতে গ্রহণের হুমকি দিয়াছেন। শেখ মুজিব বলেন : আমরা সকলের সহযোগিতা চাহিয়াছিলাম। আমরা ৬-দফা ব্যাখ্যা করিতে চাহিয়াছিলাম। গণতন্ত্রের বিধান হইতেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করিতে হইবে এবং আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ভুট্টো- একই নিয়মে
ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, যখন গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হইয়াছিল জনাব ভুট্টো উহাতে যোগ দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে তিনি নির্বাচন পিছাইবার দাবী তুলিয়াছিলেন এবং এক্ষণে পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবী তুলিয়াছেন।
এ কথার জবাব কি?
শেখ মুজিব বলেন : সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসাবে আমি ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করিতে বলিয়াছিলাম। সংখ্যালঘিষ্ঠের নেতা জনাব ভুট্টো মার্চের প্রথম সপ্তাহে আহ্বান করিতে বলিয়াছিলেন। আমি উহার বিরোধিতা করিয়াছিলাম। আবার জনাব ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত রাখিতে প্রস্তাব করেন এবং আমি আবার উহার বিরোধিতা করি।
শেখ মুজিব প্রশ্ন করেন ইহা কি সত্য নয় যে, গণতান্ত্রিক রীতি ভঙ্গ করা হইয়াছে? এই সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
ওইদিন অন্যান্য আরও যেসব সংবাদ ছাপা হয় ২রা মার্চ বুঝতে হলে তাও অবলোকন আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে-
শেখ মুজিব সকাশে-
গতকাল (সোমবার) রাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত তদীয় ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার সহিত দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। গতকাল রাতে শেখ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করেন। তিনি শেখ সাহেবের সহিত প্রায় অর্ধ ঘন্টাকাল আলোচনা করেন। ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যগণও গতরাতে শেখ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করেন।


আজ ঢাকায় ও কাল প্রদেশব্যাপী হরতাল
অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আজ (মঙ্গলবার) ঢাকা শহরে এবং আগামীকাল (বুধবার) সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল আহ্বান করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আজ ও আগামীকালের হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করিয়াছে। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আজ সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রসভা এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্যোগে আগামীকাল বিকাল ৩টায় পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে।


প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রচন্ড বিক্ষোভ
বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের মাত্র দুইদিন পূর্বে গতকাল (সোমবার) বেলা ১টা ৫ মিনিটের সময় আকস্মিক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করিয়া পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্টের বিবৃতি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা প্রচন্ড ক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। প্রেসিডেন্টের এই বিবৃতি প্রচারে দলমতনির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের ক্ষোভে দাবানলের মত ছড়াইয়া পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের সকল দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়।
‘গণঅধিকার বানচালের ষড়যন্ত্র’-নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিতে
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্রসংস্থার নেতৃবৃন্দ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তকে গণ-অধিকার বিরোধী বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। ঢাকা হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন এবং ঢাকা জেলা বার সমিতি জরুরী সাধারণ সভায় মিলিত হইয়া জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘোষণায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হইয়াছে। …..। পিডিপি সভাপতি জনাব নুরুল আমীন এক বিবৃতিতে বলেন যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে তিনি স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছেন।
পাকিস্তান জাতীয় লীগৈর সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে লেন যে, জনগণের আশা-আকাংখার প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে। সাবেক মন্ত্রী ও প্রাক্তন পিডিপি নেতা জনাব আব্দুস্ সালাম খান বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলেন যে, দেশকে বিপর্যয়ের হাত হইতে রক্ষার নিমিত্ত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন প্রস্তুত হইতেছিলেন ঠিক তৎমুহুর্তে পরিষদের অধিবেশন ঘোষণার সংবাদ রাজনৈতিক মহলকে তো বটেই, নির্বাচকমন্ডলীকেও স্তম্ভিত করিবে। প্রাদেশিক কনভেনশন মুসলিম লীগ সভাপতি জনাব শামসুর হুদা এক বিবৃতিতে বলেন যে, অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে তিনি মর্মাহত হইয়াছেন। বাংলা জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব অলি আহাদ এক বিবৃতিতে বলেন : জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখিয়া যে নাটকীয় ঘোষণা করা হইয়াছে উহা জনগণের সার্বভৌমত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা এবং গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল করার পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
শীঘ্রই পরিষদে আলোচনার ব্যবস্থা করুন-দৌলতানা
কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ দৌলতানা বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র সম্ভাবনা রহিয়াছে নেতৃবৃন্দের আলোচনায় মিলিত হওয়া। যতশীঘ্র সম্ভব জাতীয় পরিষদেই যাহাতে এই আলোচনা শুরু হয় তাহার জন্য প্রেসিডেন্টের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা নিয়োজিত করা উচিত।
‘জাতির জীবনে বিষাদের ছায়া’
‘জাতির জীবনে বিষাদের ছায়া’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেকা হয়েছে, ‘জাতির জীবনে বিষাদের ছায়া’ ঘনতর হইয়াছে। আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হইয়াছে।’……..
১১০ নং সামরিক আইন আদেশ জারি
‘খ’ এলাকার সামরিক আইন পরিচালক লে: জেনারেল সাহেবজাদা এম. ইয়াকুব খান গতকাল (সোমবার) গভীর রাত্রে ১১০ নং সামরিক আদেশ আইন জারি করিয়া প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভ্যেমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশের ব্যাপারে সংবাদপত্রসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
লেখক: পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

Leave a Reply