বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : ঐতিহাসিক তাৎপর্য

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
৭ই মার্চ ১৯৭১ খ্রি: ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ঐ ভাষণ দিয়েছিলেন। এক দিনের ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। তিল তিল করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাটা জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঐ ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তাঁর এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী “শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, কিন্তু আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারী হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে। মাননীয় প্রধাননন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অর্জনকে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল। এটা শুধু বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি নয়, দেশের জন্যও এক বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন। অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নয় বরং ইউনেস্কোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ এখন ‘‘ইউনেস্কোর কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে, এমনটা তারা বলতে পারবে। অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘‘ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির ফলে সারা বিশ্বের মানুষ এখন বিষয়টি জানবেন। ভবিষ্যত প্রজন্ম এটা জানবে যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন মহামানব, যিনি কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর ভাষণে ভারসাম্য রক্ষা রেখেছিলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু না বলে জনগণকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন। বিশ্বে আর কোনো রাজনীতিবিদ এটা পেরেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন এবং বাঙালী জাতিকে বিশ্বের কাছে বীরের জাতি হিসেবে তুলে ধরেন। দৈনিক জনকন্ঠে কবি নির্মলেন্দু গুণ ৭ মার্চ- ঐতিহাসিক ভাষণ-দিবস প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রবিবার ৩টা ১৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে আসেন এবং ৩-২০মি. তিনি ‘ভায়েরা আমার’ বলে তাঁর অলিখিত ভাষণ শুরু করেন। ঐ অগ্নিগর্ভ, মহাকাব্যিক ভাষণের স্থায়িত্বকাল ছিলো প্রায় ১৮ মিনিট। স্বাধীনতা ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন নিম্মক্তোভাবে-
”শত বছরের সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী ?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে, কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
’এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের ।”
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তারে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্Ÿান করেন, আবার ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভা পরিনত হয় এক জনসমুদ্রে। রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। সবার হাতে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু কোন মিলিটারি বিশেষজ্ঞ বা যুদ্ধ গবেষক ছিলেন না, তবু ১৮ মিনিটের একটি ভাষণে তখনকার পরিস্থিতিতে কি কি করণীয় তার সবই বলে দিলেন একজন গেরিলা কমান্ডারের মতো। কিভাবে সরকার গঠন করতে হবে, কিভাবে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, তার রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সামরিক দিকগুলো বলে দিলেন।
আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ এ দেয়া ভাষণটি যতবার বাজিয়ে শুনানো হয়েছে পৃথিবীর আর কোন ভাষণ এতসংখ্যক বার বাজানো হয়নি । এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটির বিষয়বস্তু এবং অর্šÍনিহিত ভাব ব্যাখ্যা করলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা হবে আমি নিশ্চিত! আমার এই লেখায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরতে চাই। ভাষণটির পিছনের ইতিহাস, প্রত্যাশা ও সম্ভাব্য ঘটনা উল্লেখ করে ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজারো বই লিখা হয়েছে ।
“ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁদের অধিকার চায়।” তিনি সকল বয়সের মানুষকে ভাই সম্বোধন করে তাঁর প্রত্যাশার সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের প্রত্যাশার সমম্বয় ঘটালেন।
“কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু – আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি যখনই এদেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি – তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।” পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের মানুষের অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরলেন এবং তাঁর প্রচেষ্টার কমতি ছিল না বুঝাতে চাইলেন।
“রক্তের দাগ শুকায় নাই। শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে মুজিবুর রহমান এসিম্বলিতে যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথমত, সামরিক আইন-মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। আমার লোকদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি না।” এখানে তিনি সাধারণ মানুষের কষ্টের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে শাসকগোষ্ঠিকে সর্তক করেছিলেন।
“আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট কাচারি, আদালত ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিস্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য কাল থেকে হরতাল চলবে না। রিকশা ঘোড়াগাড়ী চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভান্ডর্মেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারিরা বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল – প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো।”
“সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা”। “এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি, যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারিরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবেনা।”
“প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় – প্রত্যেক ইউনিয়নে – প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।” বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
৭ মার্চের ভাষণের যে কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছে তা হল, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ ন্যায্য কথাটা মেনে নেবার মত সাহস পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু ন্যায্য ব্যক্তি বা সরকার সব সময় নির্বাচত করে না তার ভুরি, ভুরি উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। চিন্তা করে দেখেনতো একজন নেতা কতটা সৎ, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও উদার হলে এ কথাগুলো বলতে পারে। ন্যায্য কথা মেনে নেবার মত বড় গণতন্ত্র আর হতে পারে না। আমি মনে করি গণতন্ত্রের এটাই সব থেকে আধুনিক এবং সঠিক সংজ্ঞা।
রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন,‘৭ই মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোক তাদের নেতার কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করার জন্যে এক জনসভায় সমবেত হয়। বেশীর ভাগ লোকই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি শুনতে চাইছিলেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, আমি ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা নেতাকে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছি। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনা এবং তা রিপোর্ট করার পর এক মার্কিন সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘লিঙ্কনের এই ভাষণ শোনা ও তা লেখার পর মনে হচ্ছে, আমার সাংবাদিকতা এখানেই শেষ হলে ভালো হয়। কারণ, আমি একটি ইতিহাসের অর্ন্তগত হয়ে গেছি।’ আমারও মাঝে মধ্যে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি নিজ কানে শোনার পর এবং তা নিয়ে অজস্র লেখা-লেখির পর আমিও সাংবাদিকতায় ইতি টানলে ক্ষতি ছিল না। কারণ, আমিও একটি ইতিহাসের অর্ন্তগত হয়ে গেছি এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছি।’
কিছু লেখক আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে দেওয়া ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা করতে পেরে সন্তোষ্ট। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামসহ অনেকেই লিখেছেন এ ভাষণের সাথে অন্য কোন ভাষণের তুলনা হতে পারে না। কারণ বঙ্গবন্ধু যে পটভূমিতে ভাষণটা দিয়েছেন, সেখানে আব্রাহাম লিংকনের পটভূমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আব্রাহাম লিংকন ছিলেন একটা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, তাঁর দেশের গৃহযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতিতে, সম্মানে উনি বক্তব্যটা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু একটা বর্বর, অমানবিক, স্বৈরাচারী, কুশিক্ষিত, হিংস্র পাশবিক সামরিক শক্তির কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য বক্তৃতা করেছিলেন যা ছিল অলিখিত। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেদিনের সেই দূরদর্শি বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। নিঃসন্দেহে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের বক্তৃতাও একটা কালজয়ী ভাষণ। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সতর্কতায় সেটা সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রিয় সম্পদ। যারা কথায়-কথায় লিংকনের ভাষণের সাথে ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করেছেন তারা কিন্তু একবারও দাবি রাখেননি, লিংকনের ভাষণটা যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটাও সেভাবে সংরক্ষণ করা হোক। এ বিষয়ে অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী বিভিন্ন পত্রিকায় কিছু নিবন্ধ লিখেছেন।
প্রকৃত পক্ষে ৭ মার্চের ভাষণেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। তর্কের খাতিরে তর্ক না করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলে এটা খুবই পরিষ্কার। একটা নবজাত শিশু কিন্তু তার মাকে বলে না, আমাকে খাবার দাও আমার ক্ষিদে পেয়েছে। পেটে ব্যথা করছে ঔষধ দাও। শিশুর কান্না শুনে মা বোঝে কোনটা ক্ষিদের আর কোনটা ব্যথার। ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না।’ এর অর্থ কি, এটা কি স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়েও বেশী না? এখানেই শেষ না এরপরও উনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নাকি এটা বলা খুব জরুরী ছিল, ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এক বিদেশি সাংবাদিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকাল থেকেই একজন দোভাষী খুঁজছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেবেন তা তাৎক্ষণিক ইংরেজি করে তাকে শোনাবার জন্যে। মাঠে সেদিন কত মানুষ ছিল, কেউ বলতে পারবে না। হয়তো ১০ লাখ। হয়তো আট লাখ। ভাষণ শুরুর আধঘণ্টা আগে বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ে যাই, মনে হলো সারাদেশ ভেঙে পড়েছে রেসকোর্স মাঠে। এত সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাব, ভাবতেও পারিনি। আমি প্রথম তিন-চার লাইন দ্রুত অনুবাদ করলাম, কিন্তু বিদেশী সাংবাদিকটি বললেন আমি যেন ভাষণটা শুনি এবং মনে রাখার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটা সময় সেই সাংবাদিকটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রতিটি বাক্য বুঝছেন, যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাতে নয়, ইংরেজিতে ভাষণটা দিচ্ছেন। বিকেলে সাংবাদিককে যখন মূল বিষয়গুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম, সাংবাদিক বললেন, ইট ওয়াজ সিম্পলি ম্যাজিক্যাল’। একজন অন্য ভাষার মানুষ সেও বুঝেছে যে ঐ ভাষণে জাদু ছিল, যেখানে যাদু আছে, সেখানে সব কথা তো ভেঙ্গে বলার দরকার নেই।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন তা স্বাধীনতার চেয়ে বেশী অর্থ বহন করে। বামপন্থিরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করুক। এত তিনি বিশ্বের কাছে হটকারী নেতা হিসাবে চিহ্নিত হবেন, আর সেই সুযোগটাই পাকিস্তানীরা নিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর মত কুটনি ছিলেন না এবং কুটনির মত কুটনামিকে উনি ঘৃণা করতেন। উনি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিক্ষাই শিক্ষিত ছিলেন, এবং সে শিক্ষার আলোকেই দিক নির্দেশনা দিয়েছন সেদিন। যাতে সাপ মরেছে, কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেনি। তা না হলে কামানের গুলি ও বোমার আঘাতে উপস্থিত দশ লাখের ক’জন বেঁচে থাকতো সেটা ভাববার বিষয়। মনে রাখতে হবে সেদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সব মানুষগুলো রেসকোর্সে উপস্থিত ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুসহ সবাই মারা গেলে আজও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধু কৌশলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই ২৫ মার্চ পর্যন্ত জাতি প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঢাকা ছাড়তে পেরেছিল এবং ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে সরকার গঠন সম্বব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ যতোবার শোনা যায়, তৃষ্ণা মেটে না। মনে হয় আরো শুনি। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালীর অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বাঙ্গালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতির পিতা বলা হয়। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা। সমাজতন্ত্রের সমর্থনকারী একজন বক্তা হিসেবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন বিষয়ে ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ ২৫ মধ্যরাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু করে। ঐ রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র চালনার চেষ্টা সত্ত্বেও তীব্র দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সর্বব্যাপী অরাজকতা এবং সেই সাথে ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় তিনি কঠিন সময় অতিবাহিত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে একদল বিভ্রান্ত সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে সেই সময়ে জার্মানীতে ছিলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং মাদার অব হিউমিনিটি।
সন্দেহাতীতভাবেই শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো । শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে ‘সোনার বাংলা’র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে মুজিব সেই ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তঝরা সংগ্রাম এবং দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বিজয় এবং বাংলার মানুষের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। সকলের সম্বলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। এই হোক আমাদের সকলের প্রতিজ্ঞা।


-লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, নায়েম, ঢাকা।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply