আমি যুগের ডিজিটাল নাকি ডিজিটালে মাতাল!

নাদিম ভুঁইয়া ::
হাতে রাখা স্মার্টফোনটি সময়ের সাথে এ যুগের সবকিছুই যেন রিমোর্ট হয়ে চেপে ধরেছে। ফাস্টফুড খেতে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনে এনে ওভেনে গরম করা হলেও মোবাইল ফোন সেটে সোশাল মিডিয়ার জগতে আটকে যাওয়া বা আকাশ সংস্কৃতির নেশায় স্মার্ট টিভিতে দেখতে দেখতে বুদ হয়ে শ্রেফ ঠান্ডা করেই খেতে হয়। এসি কুলারের হাওয়া বাসা-বাড়ী,বিপনী ঠান্ডা করে দিচ্ছে, প্রাণের উত্তাপ কিছুতেই কমছে না। অতীতের চিঠির ভাষা এসএমএস এসে চিন্তা-মননে এখন আবেগের দাগ কাটে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন জন্মানোর আগেই সন্তান ছেলে না মেয়ে জানার পাগলামী সাথে জটিল রোগের জীবানু ও ওষুধ আবিস্কার করে মানুষকে বেচে থাকতে সাহায্য করছে।মোট কথা, মৌলিক চাহিদার ডিজিটাল পরিবর্তনগুলো ঘুমন্ত স্বপ্ন সত্যি হয়ে দিবাকালে ধরা দিচ্ছে। আমরা খুঁজে যাবো নতুন করে আমার আমিকে, আমার চারিপাশকে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়।
ইংরেজি Digital বা বাংলায় ডিজিটাল কে বংগানুবাদে অঙগুলিসংক্রান্ত বা সংখ্যাগত এসকল অর্থ গুগল থেকে খুঁজে পাওয়া যায় । তবে ব্যাপক ভাবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সহায়তায় জীবন-জীবিকার দ্রুত প্রয়োজনে কাজ করে সেসব বিষয় বা ব¯তু বর্তমান সময়ে ডিজিটাল আশ্চর্য , বিস্ময়কর, অপূর্ব, আজব বলে গন্য করা হয়। অসম্ভব থেকে সম্ভব করে সহজ জগতে নিয়ে আনা এবং কমবেশি সকলেরই উপকারে আসা এমন কিছু ব্যবহার করে চলতে পারাই ডিজিটাল বা স্মার্ট সময়ের গতিময় জীবনধারা, অর্থাৎ আরো ভালো থাকার জন্যই যত ডিজিটাল যন্ত্র আবিস্কার ।
যখন তারযুক্ত কথাবলার টেলিফোনটা হাতে মুঠোবন্দি হলো, মানুষ রিমোটের মত চলার অভ্যাসে ডিজিটাল সুখ পেতে থাকে। বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের প্রয়োজনিয়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ এ নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে। এরপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ১২ বছরে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশন অনলাইন বিশাল কাজ করার প্রস্তুুতি নেয়,গাজীপুরের কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে ৭ একর জমির ওপর বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ডাটা সেন্টার হয়েছে। এর আপ টাইম ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এখান থেকে ডাটা স্টোরেজ ব্যাকআপ, রিকভারী, ডাটা সিকিউরিটি, ডাটা শেয়ারিং, ই গর্ভানেন্স, ই সার্ভিস পাওয়া যাবে। এর তথ্য ধারণ ক্ষমতা দুই পেটাবাইট (১০ লাখ গিগাবাইট=১ পেটাবাইট)। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৩টি, স্পেনের ২টি সৌদি আরব এবং কানাডার একটি করে ‘টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার আছে। এর মধ্যে সকল সরকারি কার্যক্রম যাতে অনলাইন সিস্টেমে চলে যায়, এর জন্য ই-নথি সিস্টেম আবিষ্কার হয়, শিক্ষা ব্যবস্থায় গতি আনতে ৪০ হাজারের উপর মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করা হয়, ডিজিটাল কৃষিনির্ভরতা করা, ডিজিটাল ব্যাংকিং এর সাথে ই-কমার্স পরিবর্তন যা অর্থনীতির উন্নতি গতি বাড়াতে থাকে। আবার টেলিযোগাযোগ সেবায় সি-মি-উই ৪ এবং সি-মি-উই ৫ কেবলদ্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং আšতর্জাতিক ভয়েস ট্র্যাফিক চলছে। সি-মি-উই ৪ এর জন্য বিএসসিসিএল-এর কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন রয়েছে কক্সবাজারে। সি-মি-উই ৫ এর জন্য বিএসসিসিএল-এর ল্যান্ডিং স্টেশন চালু হয়েছে কুয়াকাটাতে। সি-মি-উই ৬ এও বাংলাদেশ দ্রুত যুক্ত হবে। চতুর্থ প্রজন্মের তারবিহীন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মোবাইল যন্ত্রে আল্ট্রা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে। ফোরজি নেটওয়ার্কে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে মোবাইল ওয়েব সেবা, আইপি টেলিফোনি, গেমিং সেবা, এইচডিটিভি। হাই-ডেফিনিশন মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্স, ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি ২০১৮ তে উৎক্ষেপণ করা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০টি কে-ইউ এবং সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ব্যবহারে টিভি চ্যানেলগুলোর ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস চালু , প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারেও ব্যবহার শুরু হয়, বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়াার্ক তথা যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যবস্থার পন্যের শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়,বর্তমানে শুল্ক না দিয়ে অনেক গৃহস্থালী, ইলেক্ট্রনিক্স, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সহ অনেক রকম ডিজিটাল যন্ত্রাদি বর্তমান সরকার আনার সুযোগ দিয়ে রেখেছে।
সময় এখন স্মার্ট ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুগের, সকল ধরনের কাজের সমন্বয়ে বিভিন্ন রোবটিক সেবার মাধ্যমে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে একের পর এক ডিবাইস ব্যবহার বাড়ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার্তা আদান-প্রদান বা মেসেজিং সেবাটিতে গুগল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় করবে, চ্যাট করতে রোবট বসাবে এবং প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম এমন সফটওয়্যার এতে থাকবে। বর্তমানের এনড্রয়েড মোবাইল সেটে জনপ্রিয় অ্যাপস্ এর মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ফেসবুকের হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টেনসেন্টের উইচ্যাট ইত্যাদিও স্মার্ট ইন্টেলিজেন্স রোবট ব্যবহারে চলে গেছে। উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সময় শেষ হলেও ডিজিটাল ভার্চুয়াল জগত মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নাই; নিজেকে ডিজিটাল করে ভালো থাকার ও সকল কর্মকান্ড একসাথে করতে হবে, প্রয়োজনের ডিজিটালে গা ভাসানো ভালো মাতাল না হওয়া শ্রেয়।
ডিজিটাল ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এই সময়ে সকল প্রয়োজনের দাপ্তরিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক সহ নানা কর্মকান্ডের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার কাজটিও চলছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। এমনকি দৈনন্দিন কেনাকাটার মতো নৈমিত্তিক কাজগুলোও অনলাইনে সেরে ফেলছেন অনেকেই। সবচেয়ে এগিয়ে সোশাল মিডিয়া গুলো একসাথে মানব জগতের ইমোশন ছবি বা মনের ভাষা গুলো আপলোড করে যেমন সবার কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে আবার জীবন-জীবিকা মেটাতে সকল সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সত্যিই ডিজিটাল অনেক সীমাবদ্ধতা দূর করে অবারিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, দূর অনেক কাছে এসেছে,প্রাণে কৃত্রিম অস্পর্শ।
ঘুড়ির মতো ড্রোন মাথার উপর উড়ছে। এই ড্রোন অন্যরকম সুবিধায় ছবি বা ভিডিও সহজে করছে,অন্যদিকে দূর্গমে বা অসাধ্য কাজে উপকারি যন্ত্রও বটে। মন্দ কাজেও ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বলা যায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রায় সবই মানব কল্যানে আর্শিবাদ হয়ে এসেছে । উল্লেখ্য প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে অনৈতিক বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা মন্দ ব্যবহার কেউ জেনেশোনে মাতাল হয়ে করছে, কিংবা না জেনে ডিজিটাল মাতাল হয়ে অপ্রয়োজন বলছে। অতি ডিজিটাল মাতালরা কিন্তু ডিজিটাল গহবরে নিজে নিজেই একদিন হারিয়ে যেতে হবে। এরপরেও বেচে থাকার মূহর্তগুলোতে সঠিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু আপন নয় সকল মানুষের মুখে হাসি এনে দেই।সত্যিকার ডিজিটাল হই, অতি ডিজিটালে মাতাল না হয়ে ভালো থাকার প্রযুক্তিকে গ্রহন করি।
লেখক: নাদিম ভুইয়া।
[পরিচিতিঃ কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল থেকে ১৯৮৬তে এসএসসি পাশ করে অতঃপর পোস্ট গ্র্যাজুশনে শিক্ষাজীবন শেষে দীর্ঘ ১৯ বছর পুর্বাচল গ্রুপে সর্বোচ্চ ম্যানেজার পদের কর্মকর্তা পর্যন্ত সুনাম ও মর্যাদা নিয়ে কর্মরত থেকে স্কেচ্ছায় অবসরে যাওয়া হয়। বর্তমানে আমদানিকারক ব্যবসায় জড়িত। স্ত্রী বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারে সুনামের সাথে কর্মরত। একমাত্র ছেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে EEE তে পড়ে। স্থায়ী নিবাস ঢাকায়।]

শেয়ার করুন

Leave a Reply