বই এবং আমার ভুবন

বই পড়তে কবে থেকে বা কীভাবে শুরু করেছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে শুরু। এরপর এক বন্ধুর বাবা ( ঝুমুর সাহা) ওনার অনেক বই ছিল। তখনই কাকার সারি সারি বই রাখার কাঠের সেলফ ছিল। মনে আছে দোতলা বাসার ওই রুমে কতো বই নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। মাসুদ রানা, অনুবাদ, ওয়েষ্টটার্ন সিরিজের বই ওখান থেকেই পড়া শুরু। এরপর কীভাবে কীভাবে যেন সুনীল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, আর বুদ্ধদেব পড়তে শুরু করেছিলাম। বুদ্ধদেব কখন যে আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলো বুঝে উঠতে উঠতে জীবনের অনেক সময় চলে গেলো ভালো লাগায়, মুগ্ধতায়। আগে ভাবতাম বই কেন মানুষের বন্ধু? এখন এ-ই বয়সে এসে বুঝি, এতোটা আপন, নির্ভার, আর ডুবে যাওয়া শুধু বই দিতে পারে। নিজেকে চিনতে, নিজের ভুবন তৈরি করতে আর মনের সব ক’টি জানালা খুলে আলো আর সমস্ত ভুবন চোখের সামনে তুলে ধরার এমন অসীম ক্ষমতা আর কিছুরই নেই। বই পড়তে শুরু করলে কখন যে সময়গুলো এগিয়ে চলে বুঝতে পারি না। মাঝের কিছু সময় পড়তে পারছিলাম না। সে সময়টুকু আমি কোন শব্দে আবদ্ধ করতে পারবো না। অস্থির লাগতো। মনে হতো চারপাশের বাতাসে আমি নিঃশ্নাস নিচ্ছি কিন্ত প্রানের প্রানশক্তি মুখরিত হচ্ছে না। ক্লাস সিক্স যখন পড়ি, তখন স্কুলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে বয়স ভিত্তিক বই পড়া কার্যক্রম শুরু হয়। তখন বুঝিনি এখন বুঝি, সেই তিন বছরে যে ৩৬ টা বই পড়েছিলাম তা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের সন্তান। তারপর থেকে মনে হতো, এখনো মানি বই মানুষের ভিতরে গভীরতা তৈরি করে। একটা মানুষ কে বদলে দেয়। মানুষ নিজেকে আলাদা করতে পারে। প্রকৃতি চিনতে পারে অন্য রকম ভাবে। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তা হয় না। চলার পথে এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যাঁরা আমার চেয়েও অনেক বেশি অন্য মাত্রার বইয়ের জগৎ এ বিচরন করেছেন কিন্তু কোথায় যেন কী নেই! প্রথম প্রথম অবাক হয়েছি। ভাবতাম এমনতো হওয়ার কথা নয়। কাছের কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে টের পেয়েছি এটা আমি না, তাঁরাও টের পায়। উত্তর টা আমি জানিনা। আমি অনেক বেশি অজ্ঞ এ-ই বিশাল উত্তর জানা’র জন্য। তবে এটা টের পাই ধারণ করার তৌফিক আল্লাহ সবাই কে সমান দেননি। যেমন একই আকাশ আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখি। কেউ সেখানে শুধু সাদা মেঘ দেখে। কেউ সেখানে সমুদ্র দেখে। মনের স্বচ্ছতা অনেক বড় দামী। এটা যেমন মানুষকে পোড়ায় আবার পুড়িয়ে খাদহীন সোনায় পরিনত করে। আমি তো শুধু উপন্যাসের যাত্রী। আমি হিংসা করি, যাঁরা সব ধরনের বই পড়েন। মনে হয় আমি যদি তাদের মতো হতে পারতাম! একটা বই ভিন্ন বয়সে ভিন্ন আমেজে ধরা দেয়। “মাধুকরী” বুদ্ধদেবের অসাধারণ লিখা। যখন প্রথম পড়ি তখন রাত জেগে পড়েছি। অনেক দিন ধরে মনে হচ্ছিল আবার পড়বো। হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না। সেদিন হঠাৎ একজন দিলো। পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, আহা কতো কিছু নতুন…. আসলে কী তাই! হয়তো হ্যা, হয়তো না। বই পড়তে না পারলে হয়তো অধরাই থেকে যেতো অনুভবের স্তর গুলো। সেখানে রঙের ফানুস উড়ানো যেতো না। নিজেকে চিনতে পারতাম না। নিজের জন্য যে ভুবন তাতে কোন ইমারত তৈরি করতে পারতাম না। ছোট বেলায় কতো বকাঝকা খেয়েছি, পড়ার বইয়ের ভিতর গল্পের বই ঢুকিয়ে পড়ার অপরাধে। বড় বোনের পরীক্ষার আগে আব্বা এ-ই চুরি ধরে ফেলেন তাঁর। শাস্তি হিসেবে তাঁর ইন্টারমিডিয়েট এর সব বই আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন অনেকে “ই” বুক পড়েন। পাওয়া সহজ, কিন্ত আমি এনালগ যুগে রয়ে গেলাম। সব আধুনিকতা হয়তো মনের গভীরতা, অনুভবের প্রসারতায় জায়গা পায় না। আমি বই হাতে নিয়ে স্পর্শ করে তাকে অনুভব করি। মনে হয় আমার সাথে সে কথা বলে, হেসে উঠে মুগ্ধতায়। তার বুকের গভীর মদির গন্ধে আমি আকূল হই। তারপর তাকে জাপটে ধরে তার মাঝে ডুব দেই। হারিয়ে ফেলি নিজেকে। অদ্ভুত সময়…. আমি বেঁচে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত যেন পড়ার এ-ই রোগটুকু লালন করতে পারি। আমার জাগতিক সংসারে সেও আমার সন্তান।
লেখক পরিচিতিঃ শিক্ষক

শেয়ার করুন

Leave a Reply