অধ্যবসায়ই স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন :
সফলতা অর্জনের প্রথম ও অনিবার্য শর্ত হলো অধ্যবসায়। উন্নত জীবন ও টেকসই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে  অধ্যবসায়ের বিকল্প নাই। অধ্যবসায় ছাড়া ব্যক্তি জীবন কিংবা জাতীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা কল্পনা করা যায় না। অধ্যবসায়ই কোন ব্যক্তির সহজাত ক্ষমতা, গুণাবলী ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী করে তোলে এবং বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ, যোগ্য ও মানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে । তাই কবিতার ভাষায় বলতে হয় –
শ্রম অনুপাতে হয় উন্নতি সাধন,
যে চায় উন্নতি, করে রাত্রি জাগরণ।
যে জন চায় মুক্তা, ডুবে সিন্ধুজলে,
তবে তো রতন লাভ ভাগ্যে তার ফলে।
যতন বিনা চাহে রতন যেই জন,
অসম্ভব আশা তার বিফল জীবন।

কথায় বলে অকৃতকার্য হওয়ার মাধ্যমেই কৃতকার্য হওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হয়। যে কোনো কাজেই সফলতা বা ব্যর্থতা দু’টিই আসতে পারে। জীবনে সব কাজে মানুষ প্রথমবারেই সফল হবে এমন নয়। কোনো কোনো কাজে প্রথমবার, এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারে সফলতা নাও আসতে পারে। তাই বলে ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে, হতাশ হয়ে, থেমে থাকলে চলবে না। বরং ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে সফলতা না আসা পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে, এরই নাম অধ্যবসায়। এ প্রসঙ্গে কবি যথার্থই বলেছেন-
‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।’

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সকলেই চায় অকৃতকার্য শব্দটি যেনো আর ডিকশনারিতে না থাকে। কথিত আছে কুমিল্লা কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সাতবার পরীক্ষা দিয়ে এন্ট্রান্স, তিনবারে আই.এ., দুইবারে বি.এ. এবং ইংরেজি বিষয় নিয়ে একবারে এম.এ. পাস করেছিলেন। কি অপূর্ব অধ্যবসায়! তাঁর ছাত্ররা বলতেন তিঁনি নেচে নেচে ইংরেজি পড়াতেন। চমৎকার ইংরেজি তাঁর মুখ হতে অনর্গল বের হয়ে আসত। আজকাল শিক্ষার্থীরা ফেল কথাটাকে বড় লজ্জাজনক মনে করে। তাই অসৎ উপায়ে পাস করে মুখ রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করার জন্য অনেক সহযোগীও যোগাড় হয়ে যায়।

প্রকৃতি সকল মানুষকে একই ধরনের মেধাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেননি। কেউ বুদ্ধি করে কোনো একটি কাজ একদিনে করতে পারে, কেউ বা তা করতে পারে দুদিনে, আবার কারও সে কাজে তিন দিনও লাগতে পারে। তাছাড়া আমরা দেখি হাতের পাঁচটি আঙ্গুল সমান নয়। ভূপৃষ্ঠ সমতল নয় বলেই আমরা সহজে হাঁটতে পারি। বেশি মসৃণ হলে পা পিছলে পড়ে যেতাম। শরীরের সঠিক ব্যালেন্স রাখা সম্ভব হত না। ভূপৃষ্ঠ উঁচু-নিচু হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পানি আটকিয়ে থাকে এবং সেখানে বিশেষ ধরনের ফসল জন্মে। সব জায়গা সমতল হলে, সব বৃষ্টির পানি গড়িয়ে সমুদ্রে চলে যেত। উত্তরে হিমালয় পর্বত, গাড়ো ও লুসাই পাহাড় না থাকলে বাংলাদেশ হয়তো মরুভ‚মি হয়ে যেত। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মূল্য, অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত গুরুত্ব, ব্যর্থতা আছে বলেই সফলতার এত মূল্য। যদি সব রাত্রই শবেকদরের রাত্রি হতো তবে শবেকদরের মূল্য থাকত না। নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের মূল্য বাপ-দাদার রেখে যাওয়া অর্থের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তাই শিক্ষার্থীদের বলব পরের ধন ভোগ করার মধ্যে আনন্দ নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে বিধায় নকল করে পাস করার চিন্তা পরিহার করতে হবে। কবিতার ভাষায় বলতে হয়-
হাঁটতে শেখেনি কেহ, না খেয়ে আছাড়,
হাঁটতে শিখতে হলে হাঁট বারবার।

পৃথিবীতে যা কিছু মহান, যা কিছু কল্যাণকর তা সবই অধ্যবসায়ের গুণে অর্জিত হয়েছে। অধ্যবসায় মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রথম সোপান। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ যুগে যুগে জয় করেছে মহাসাগরের অতলগর্ভ, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, এমনকি মহাকাশও। জীবনে চলার পথে প্রতি পদক্ষেপে যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতে পারে সেই সফল। সুতরাং মানবজীবনে অধ্যবসায় অপরিহার্য। শিক্ষাজীবন ব্যক্তির মানস গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। পরবর্তী জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার উপযুক্ত সময়। তাই শিক্ষাজীবনে অধ্যবসায়ের গুণ আয়ত্ত¡ করা সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। অধ্যবসায় ব্যতীত শিক্ষাজীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। অলস ও শ্রমবিমুখ শিক্ষার্থী যতই মেধাবী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সে বিদ্যার্জনে সফলতা লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র বা ছাত্রী স্বল্প মেধাসম্পন্ন হলেও ভালো ছাত্র হিসেবে নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-Failure is the pillar of success.

প্রতিটি জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব জাতির গোড়াপত্তন এবং অগ্রগতির পেছনে আছে শত সহস্র বছরের অসংখ্য মানুষের যুগ-যুগান্তরের সাধনা। প্রবাদ আছে-‘রোম নগরী এক দিনে তৈরি হয়নি।’  স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুশ ইংলান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে ছয়বার হেরে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে, একটা মাকড়শা তার জাল বুনতে গিয়ে ছয়বার ব্যর্থ হয়ে সপ্তমবারে সফল হয়েছে -তখন তিনি পুনরায় উৎসাহিত হলেন এবং সপ্তমবারে যুদ্ধে জয়ী হলেন। স¤্রাট বাবর এক যুদ্ধের সময় ভয়ে ভীত হয়ে একটি ভাঙ্গা অট্টালিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন একটি পিপীলিকা একটি দেওয়ালে উঠতে গিয়ে ঊনষাটবার ব্যর্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল এবং ষাটবারের সময় সফল হয়েছে। এতে তাঁর উৎসাহ আরো বৃদ্ধি পায় এবং তিনি যুদ্ধে জয়ী হন। মানুষের দেখা উচিত ক্ষুদ্র পিপীলিকা ও মাকড়শা কতটা অধ্যবসায়ী। ছোট বেলায় পড়েছি একটি তৃষ্ণার্ত কাক কীভাবে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্ধভর্তি কলসিতে নুড়িপাথর ফেলে কলসির পানির উচ্চতা বাড়িয়ে সেখান থেকে পানি পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছে । কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প কে না জানে ! মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব তাদের উচিত বারবার চেষ্টা করা, তাতে সফলতা এসে তাকে সালাম করবেই। মানুষ তখন পরম আনন্দ উপভোগ করে। কবিতার ভাষায় বরতে হয়-
পাছে কোন বিঘ্ন হয়, এই ভাবি মনে,
কার্যে নাহি হাত দেয় যত নীচ জনে।
একবার বাধা পেলে মধ্যম যে জন,
হতাশ হইয়া করে চেষ্টা বিসর্জন।
কোন কাজ ধরে যদি উত্তম যে জন,
হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত যারাই কীর্তিমান বলে পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁরা নিজেদের প্রতিভার চেয়ে অধ্যবসায়ের প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন। বিজ্ঞানী নিউটন এ প্রসঙ্গে বলেন-‘আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরূæহ তত্ত¡গুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।’  ডালটন বলেন-‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না।’ ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার যথার্থই বলেছেন- ‘প্রতিভা বলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।’

প্রতিভার সঙ্গে অধ্যবসায় যুক্ত হলেই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। অধ্যবসায় না থাকলে প্রতিভা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। গ্রীসের বাগ্মীপ্রবর ডিমস্থিনিয়া প্রথম জীবনে তোতলা ছিলেন। স্বীয় অধ্যবসায়ের বলে পরবর্তীতে তিনি গ্রীসের বিখ্যাত বক্তা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার মুঘল সাম্রাজ্যেও বাবর প্রথম জীবনে রাজ্য থেকে নির্বাসিত হলেও পরবর্তীতে অদম্য অধ্যবসায়ের বলে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হতে পেরেছিলেন। অর্ধ-পৃথিবীর অধিশ্বর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাঁর জীবনালেখ্যের মাধ্যমে অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন- Impossible is a word which is found only in the dictionary of a fool.

আধুনিক বিশ্বে সফলতার খ্যাতি অর্জনকারী কয়েকজন ব্যক্তি যেমন- বৈদ্যুতিক বাতির আবিস্কারক টমাস আলভা এডিসন, আলী বাবা ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা, ম্যাগডোনাল্স এর প্রতিষ্ঠাতা রে ক্রক, হোয়াটস অ্যাপ এর আবিস্কারক জ্যান কৌম, কে এফ সি এর প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল সেন্ডারস, ওয়াল্ট ডিজনি, স্টারবাক্স এর প্রতিষ্ঠাতা হাওয়ার্ড স্কালটজ এদের উন্নতি ও মানবসেবার ইতিহাস অধ্যয়ন করলে সম্মানিত পাঠক আপনারা অনুপ্রাণিত হবেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়ার মতো প্রথম সারির দেশগুলোর উন্নতির মূলমন্ত্র অধ্যবসায়। কেবলমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই এসব দেশ উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রত্যেক মানুষের মনে রাখা উচিত আল্লাহ তাদেরকেই সাহায্য করেন, যারা অধ্যবসায়ী এবং পরিশ্রমী। তাই সফলতার পথে এগিয়ে যেতে আমাদের সবাইকে হতে হবে অদম্য অধ্যবসায়ী।

লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়

শেয়ার করুন

Leave a Reply