এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান ::
‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম’-১৯৭১ সালের ৮ই মার্চের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম এটি। সাব-টাইটেল ছিল- ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিব কিনা ঠিক করিব।’
দৈনিক আজাদের প্রধান শিরোনাম ছিল-‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। দৈনিক ইত্তেফাকের আট কলাম শিরোনাম ছিল-‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি-(ক) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়, (খ) সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নেওয়া হয়, (গ) নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় এবং (ঘ) নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।’
এ তিনটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম পড়ে তৎকালীন বাঙালিদের আর বুঝতে বাকি থাকেনা বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় দেশবাসীকে কি বলেছিলেন। রাজপথের উত্তপ্ত জনতা, ব্যারাকের সৈনিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষক-শ্রমিক-চাকরিজীবী বুঝে নেয় তাদের করণীয়। সেভাবেই প্রস্তুতি চলতে থাকে। সেভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে বাঙালীর আজীবনের আরাধ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনের বক্তৃতায় আর কি কি বলতে পারতেন? কিছু কি আরও কম-বেশি বলতে পারতেন-এমন প্রশ্ন অনেককেই করেছি। কেউ কোন উত্তর দিতে পারেন নি। তিনি কি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন কিংবা করেন নি-এর কোন উত্তরও কারো জানা নেই। এভাবেই একজন নেতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক সমর্থিত সরকারকে ধোঁয়াশায় ফেলে নিজের রণপ্রস্তুতি ঠিক করে নিলেন, একটি কবিতায় লক্ষ মানুষকে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করলেন, একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। একটি তর্জনীর কত মোহময়তা-পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো নিরুপায় দেখে নিল।
জাতির পিতার সে ভাষণ নিয়ে বিগত ৫০ বছরে অনেক লেখালেখি হয়েছে, আরও হবে। তবে এ ভাষণ নিয়ে কেউ এ পর্যন্ত পিএইচডি করেছেন বলে আমার জানা নেই। এত এত কিছু নিয়ে পিএইচডি করা হয় সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে, এ ভাষণ নিয়ে কেন করা হয়না? কেউ কেউ এ ভাষণকে কালজয়ী ভাষণ বলেছেন। কেউ বলেছেন মহাকাব্য। কেউ তুলনা করেছেন গেটিসবার্গ, ম্যাগনাকার্টার ভাষণের সাথে। তাহলে সে ভাষণ নিয়ে আমি/আমরা গবেষণা করি নি কেন? আমরা তো অনেকেই পিএইচডি করেছি এ ভাষণের পরেই এবং অন্য কিছু নিয়ে। একইভাবে প্রশ্ন করা যায় কত কত হত্যা রহস্য নিয়ে গবেষণা করা হয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যা রহস্য নিয়ে কেন করা হয় না? একটা উক্তি খুব মনে ধরেছে। সেটি হলো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনই হওয়া উচিত বাংলাদেশের রাষ্টবিজ্ঞান। তা কি হতে পেরেছে? কবে হবে? বিশ্বাস করি ৭ই মার্চের প্রত্যেকটি বাক্য নিয়ে আলাদা আলাদা গবেষণা হতে পারে। সুরকার গবেষণা করতে পারেন এ ভাষণের মন্ত্রমুগ্ধ সুর লহরী নিয়ে। সামরিক বিশ্লেষক গবেষণা করতে পারেন ভাষণে বর্ণিত যুদ্ধ কৌশল নিয়ে। রাজনীতিক গবেষণা করতে পারেন এর প্রজ্ঞা নিয়ে। গবেষণা হতে পারে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর উঠা-নামা নিয়ে, জেস্চার-পস্চার নিয়ে। এমন তর্জনীর নাচন কে কবে করতে পেরেছে? তর্জনীর দোলায় দুলছে লাখো জনতা, নীরব হচ্ছে, চিৎকার করে উঠছে, গমগমা শব্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। তর্জনীর সে কি সৃষ্টি, সে কি ক্ষমতা, মোহময়তা!
বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্লেষণ করেছেন। ‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’-নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতা যেন ৭ই মার্চের ভাষণের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে।
কেউ কেউ বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই ভাল করতেন। আমি বলি, না দিল কোথায়? স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম পড়ে-শুনেও আপনি যদি না বুঝেন, তাহলে আপনার রাজনীতি, সমরনীতি বুঝার দরকার নেই বা যোগ্যতা নেই। বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের একটি বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি থেকে ধারণা নেওয়া যাক “এটা পরিষ্কার ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ এবং রাজনীতি সচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দায়িত্বের ভার ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর দলের ওপর ন্যস্ত। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার সার্বিক ফলাফল তাই সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন ছিল। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থ দাঁড়াত সামরিক বাহিনীকে তার সকল শক্তি নিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করা। এতে তারা যে শক্তি প্রয়োগের ছুতো খুঁজে পেতো তাই নয়, বল প্রয়োগে তাদের ইচ্ছে চরিতার্থ করতে তারা সব কিছুর ওপর সকল উপায়ে আঘাত হানত। কোনো নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী কি ওই ধরনের হামলার আঘাত সহ্য করে বিজয়ী হতে পারে? বহির্বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়াই বা কী দাঁড়াবে? অন্যান্য দেশের সরকারগুলো কি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে? একটি সুসংগঠিত সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যতদিন প্রয়োজন ততদিন টিকে থাকতে পারবে তো? অজস্র প্রশ্নের মধ্যে এগুলো ছিল কয়েকটি যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হলো। বৈঠকে শেখ মুজিব বিভিন্ন মত শুনলেন, তবে নিজের অভিমত সংরক্ষিত রাখলেন”-(ড. কামাল হোসেন: মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল) বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব, একনিষ্ঠ সহচর প্রাক্তন মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা যেন ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার একেকজন দূত। সেদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উম্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উম্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল”-দৈনিক যুগান্তর, ৭ই মার্চ, ২০১০।
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের অন্তরের চাওয়া পাওয়ার প্রতিচ্ছবি, হৃদয়ের উপলব্ধি। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “৭ র্মাচরে ভাষণে প্রতিরোধ আন্দোলনের এই লোকায়ত রূপ মেলে ধরার পাশাপাশি প্রত্যাঘাতের ডাক এমন এক লোকভাষায় ব্যক্ত করলনে বঙ্গবন্ধু যে তিনি উন্নীত হলেন অনন্য লোকনায়কেরভূমিকায়, যার তুলনীয় নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনেরকাফেলায় বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার লোকঐতিহ্য ও জীবনধারার গভীর থেকে উঠে আসা ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবঅধিষ্ঠিতহয়েছিলেনজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার নেতৃভূমিকায়। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যে কতটাস্বার্থকনামা হয়ে উঠেছিলেন, তার পরিস্ফুটন ঘটেছিল সংকটময় মার্চ মাসে তাঁর অবস্থান ও ভূমিকা এবং ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে”-দৈনিক যুগান্তর, ৭ মার্চ, ২০১০।
৭ই মার্চের ভাষণকে আওয়ামী লীগ নেতা নুহ-উল-আলম লেনিন আখ্যা দিয়েছেন বাঙালীর সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের শিল্পরূপ হিসেবে। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন, “শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের এক অনবদ্য শিল্পরূপের সমাহার ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তায়, কাজে, রণনীতি ও রণকৌশলে। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতা, দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণের প্রতিকূলতা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেতৃত্বদানে আওয়ামী লীগের মতো গণভিত্তিক দলের সীমাবদ্ধতা (রেজিমেন্টেড নয় বলে), সশস্ত্রযুদ্ধের পশ্চাৎভূমি হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের দীর্ঘমেয়াদে দায় গ্রহণের সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বাংলাদেশের টিকে থাকার সক্ষমতা এবং সর্বোপরি ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের (অর্থাৎ আজকের পাকিস্তানের) সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার অসামর্থ্য প্রভৃতি বিষয় বঙ্গবন্ধু বিবেচনায় নিয়েছিলেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস”-দৈনিক ইত্তোক, ৭ মার্চ, ২০১১।
“একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে যাতে চিহ্নিত না হন সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি দেখেছেন নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে (১৯৬৭-১৯৭০) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে বৃহৎ শক্তির সহযোগিতায় কঠোরহস্তে দমন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কৌশল ছিল অপূর্ব- তিনি বলেন বাঙালিরা মেজোরিটি, তারা বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনোরিটি পশ্চিম পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বঙ্গবন্ধু অনুসৃত এ যুদ্ধ কৌশল পৃথিবীর সকল সমর নায়কদের হার মানিয়ে দেয়”-ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ মার্চ, ২০১১।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী ইপিআর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলায় দেয়া বক্তৃতায় বলেন, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল চলছে এবং ঘোষণা করা হয়েছে ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। আমরা অপেক্ষায় আছি যে, সে ঘোষণায় তিনি কী দিকনির্দেশনা দেন। … সেদিন আমার অনুভব হয়েছিল, তাঁর ভাষণে আমাদের প্রত্যেকের জন্য শুধু নয়, সামরিক বাহিনীর প্রতিটি বাঙালির জন্য কী করণীয়, বঙ্গবন্ধু সে নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে ভাষণে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশের পরই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে।”
৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা দরকার। কারণ একটা ৭ই মার্চের এ ভাষণ একটা জাতিরাষ্ট্রের জন্মের নিয়ামক। পুরো বাঙালী জাতি, এর সাথে আরও অনেকে কেঁপেছিল, আন্দোলিত হয়েছিল, আলোড়িত হয়েছিল, জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল এ ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে। ৭ই মার্চের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ বাঙালীর হৃদয়ে চির ভাস্বর থাকুক, আগামীর পথ দেখাক-এই প্রত্যাশা- পিআইডি ফিচার
পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর

শেয়ার করুন

Leave a Reply