করোনাকালীন ছুটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর করণীয়

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::

জন্মের পর থেকে শুনেছি, পড়েছি, শিখেছি এবং বলেছি যে বিপদে সংঘবদ্ধ হতে হবে, পরস্পর পাশে থাকতে হবে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মিটিং মিছিলে একত্রিত হয়ে ভালোবাসার বন্ধন রচনা করতে হবে ইত্যাদি।মানবজাতি পৃথিবীতে আর্বিভাবের শুরু থেকে সামাজিকীকরণ অর্থাৎ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করার চেষ্টা করে আসছে।আর এখন বলা হচ্ছে পরস্পর দূরে দূরে থাকতেহবে,কারণ আমরা যেন নিজেরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্তনা হই এবং অন্যকে আক্রান্ত না করি। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন জীব, তা সত্তে¡ও সামান্য এবং অতিআণুবিক্ষণিক একটি ভাইরাস আমাদের সাজানো-গোছানো সংসার, সমাজ, দেশ এমনকি গোটা বিশ্বের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।এই অদৃশ্য ভাইরাসটি ধনী, গরীব, পুরুষ-মহিলা, ধর্ম, বর্ণ কিছুই বিবেচনা করছে না। যাকে পারছে তাকেইআক্রমণ করছে, যাকে আক্রমণ করেনি তারাও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমরা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যুদ্ধ হলে শত্রæসেনার সাথে প্রাণপণ লড়ে জয় বা পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করাযায়। আর পরাজয় হলে নিজেদের দুর্বলতাগুলো খুজে বের করা যায়। কিন্তু আমরা এমন এক শত্রæর সঙ্গে লড়ছি যাকে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত চিন্তা করছি কখন যে কার শরীরে ঢুকে জীবন নাশ করে দিবে কে জানে? পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, আক্রান্তনিকটাত্মীয়কে পর্যন্ত দেখতে যেতে পারছি না ইত্যাদি। বিষয়টি বড়ই কষ্টকর!
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নেমনেকিছুটা আশার আলো জাগে যখন দেখি আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের আপামর জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।নিজের ঘুম হারাম করে সার্বক্ষণিক আমাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করছেন এবং নানাভাবেসতর্কতামূলকনির্দেশনা দিচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আন্তরিক ধন্যবাদ দেশের অগণিত ডাক্তার, নার্স, সংবাদকর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তাদের, যাঁরা কিনা মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত দেশবাসীর সেবা করে যাচ্ছেন।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অন্যান্য বিষয়ের সাথে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও স্থবির হয়ে পড়ছে।প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সকল শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং এতৎসংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। কারণ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি সাধারণ ছুটির আওতায় বন্ধ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ। গত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে এবং আগামী ৬ মে ২০২০ পর্যন্ত সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধরাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, রমজান ও ঈদুল ফিতরসহ অন্যান্য ছুটি মিলিয়ে ৩০ মে পর্যন্তশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি থাকবে।এ পরিস্থিতির উন্নয়ন হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ আগামী ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্তহয়তো খুলে দেয়া সম্ভব হবে না। প্রশ্ন হলো, এই দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণকিভাবে সময় কাটাবে? দু’দিন আগে হোক আর দু’দিন পরে হোক করোনার তাÐবহয়তোথেমে যাবে !হয়তোজীবনযাত্রা তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে!তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য তখনকার হিসাব এখন থেকেই আমাদেরকে করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা যদি কর্মহীন হয়ে বসে থাকেন তাঁদের শিক্ষকতা পেশায় অদক্ষতা প্রকাশ পায়। শিক্ষকদেরপ্রতিনিয়ত পড়াশোনা, পাঠ-পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং শিক্ষাসহায়িকার ব্যবস্থা করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে তাঁদেরকর্মদক্ষতা লোপ পায়,স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘিœত হয়, শারীরিকভাবেও স্থূলকায় হয়ে অনেকে রোগব্যাধির সম্মুখীন হন। অভ্যাসমতো ঘুম থেকে ওঠা, প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ক্লাসে যাওয়া এবং যথারীতি পাঠদানে ব্যস্ত থাকা তাঁদের নিয়মিত কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের বিচ্যুতি ঘটে। এজন্য সম্মানিত শিক্ষকমÐলী এই কঠিন সময়েজীবনের নিরাপত্তা ছাড়াই বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যাচ্ছেন ক্লাস নেয়ার জন্য। শুধু সংসদ টিভিতে ক্লাস নিয়েই তাঁরা ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তাঁরা বাসায় বসেও নিজ উদ্যোগেপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্মেক্লাসতৈরি করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ক্লাস তৈরি করছেন। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং২০৩০ সালের মধ্যে গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দেশের প্রায় সকল শিক্ষকই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান থেকে আইসিটি ও মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক ডিজিটাল কন্টেন্ট প্রস্তুতি বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এ প্রশিক্ষণ অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস প্রস্তুতি ও পরিচালনা করার জন্য কাজে আসছে। এ প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধাভাজন প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ অন্য সকল শিক্ষককে উৎসাহদানের পাশাপাশি নিজেরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের তৈরি ক্লাস আপলোড করতে পারেন। এটুআই এর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘শিক্ষক বাতায়ন’ ও ‘কিশোর বাতায়ন’ এবং‘মুক্ত পাঠ’প্লাটফর্মেসকল শ্রেণির সব বিষয়ের পাঠসামগ্রী রয়েছে। শিক্ষকগণ ঘরে বসে তা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কাজে সহযোগিতা করতে পারেন। সকল শ্রেণিশিক্ষক শিক্ষার্থীদের ফোন করে ক্লাসের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন। যেসব শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেই তাদেরকে মোবাইল ফোনে অনুপ্রেরণামূলক বার্তা পাঠিয়ে বা কথা বলে তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে পারেন।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে দীর্ঘ সময় ছুটি থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ, “আমার ঘরে আমার স্কুল” কার্যক্রম শুরু করেছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় শিক্ষার্থীরা ২৯ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে ‘সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে’ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৬ষ্ঠ হতে ৯ম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক পাঠদান এবংপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাস রেকর্ডিং করে “ঘরে বসে শিখি” কার্যক্রম টেলিভিশনে স¤প্রচার শুরু করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্লাসসমূহ উপভোগ করতে পারছে। বিষয়ভিত্তিক অনেক লেকচার কিশোর বাতায়নও ইউটিউবে শ্রেণি অনুযায়ী আপলোড করা হয়েছে। এছাড়া টেন মিনিট স্কুল, অন্যরকম পাঠশালা, ব্র্যাক ই-শিক্ষা কর্মসূচি, খান একাডেমিসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিষয়ভিত্তিক কিছু কিছু লেকচার রয়েছে। কিছু সংখ্যক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জেলাভিত্তিক অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেছে।
শিক্ষকরা সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে সমাজে সমাদৃত। তাঁরা সমাজ-বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সাধারণ মানুষ শিক্ষকদের কথা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে শোনেন ও মানেন,তাই সারাদেশে আমরা যে-সকলশিক্ষক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছি, আমরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করতে পারি। সচেতন করতে পারি আমাদের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পাড়া-প্রতিবেশীদের। এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবদের সাথে নিয়ে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে এলাকার সবাইকে উপদেশ দিতে পারি। অনলাইন পত্রিকায়ও ফেসবুকে সঠিক তথ্য লিখতে পারি, বিজ্ঞান ভিত্তিক সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে সচেতন করতে পারি, রোধ করতে পারি গুজব ও অপপ্রচার এবংপ্রচার করতে পারি সরকারি নির্দেশনা। আমাদের চারপাশের কারোর করোনার লক্ষণ (অস্বাভাবিক সর্দি, কাশি, জ্বর, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট) দেখা দিলে তাকে কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারিন্টাইনে থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পারি। প্রয়োজনে ৩৩৩ বা ৯৯৯ অথবা ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে দিতে পারি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা।আমরা সাধারণত কাউকে ফোন করে সালাম বা সম্ভাষণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করি : কেমন আছেন, বাসার সবাই কেমন আছেন ইত্যাদি। এখন এর সঙ্গে জিজ্ঞেস করতে পারি : আজ ক’বার হাত ধুয়েছেন বা এ রকম আরও করোনা সচেতনতামূলক কথা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জিনিস না ক্রয়ের জন্য আহŸান জানাতে পারি। যিনি রোগাক্রান্ত হয়েছেন তিনি আমাদের শত্রæ নন, তাঁর শরীরে অবস্থিত জীবাণু আমাদের শত্রæ। তিনি নিজে এর জন্য দায়ী নন। তিনি পরিস্থিতির শিকার।তার কোনো অপরাধ নেই। তার সাথে এমন আচরণ করা যাবে না যাতে তিনি মনে কষ্ট পান। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাঁকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হবে, মুক্ত রাখতে হবে অপচিকিৎসা থেকে। কেউ করোনা রোগে মারা গেলে ধর্মীয় ও সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে তাঁর লাশ সৎকার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মৃত ব্যক্তির সৎকার জীবিত ব্যক্তির নিরাপত্তা, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব।
বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি থাকায় শিক্ষার্থীরা বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে। এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীগণ কিভাবে তাদের মূল্যবান সময়টাকে নিজেদের, দেশের, সমাজের উপকারে কাজে লাগাতে পারে এবিষয়ে কিছু মতামত দিতে চাই। আজকের শিক্ষার্থীরা হলো আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্য থেকেই আমরা পাব বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ, দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা, খেলোয়াড়, সমাজকর্মী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। তারাই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাবে এবং দেশের গÐি পেরিয়ে বিশ্বকল্যাণে কাজ করবে। এইজন্য শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষরূপে গড়ে উঠতে হবে। এজন্য তাদেরকে দৃঢ় মনোবল-সম্পন্ন, অধ্যবসায়ী, শৃঙ্খল ও সময়ানুবর্তী হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ হলো পড়ালেখা করা, কাজেই সে বিষয়ে তাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা এখন বাড়িতে অনেক সময় পাচ্ছে, এ সময়ে ঘরে বসে নিজেদের পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে,পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় গ্রন্থ, শিক্ষামূলক গল্প, মনীষীদের জীবনী, বঙ্গবন্ধুর জীবনীনির্ভর বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পারাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাছাড়া নিজ দেশ সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পড়া, মা-বাবা, ভাই-বোনের সাহায্য নিয়ে যে বিষয়টি কম বোঝ সেটি শিখে নেয়া, বাড়ির বুকশেলফে উপযোগী কোন বই থাকলে সেগুলো পড়ে ফেলা, ওয়েবসাইটে থাকা উপযোগী পাঠসমগ্রী প্রয়োজনে ডাউনলোড করে নেয়া, এটুআই নিয়ন্ত্রিত‘মুক্ত পাঠ’ ওয়েব পেজে প্রয়োজনীয় সেশন দেয়া হয়েছে সেখান থেকে নিজে নিজে পড়ে, নিজে নিজে পরীক্ষা দেয়া (ই-র্লানিং) ইত্যাদি হবে বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীর কাজ। ইতিমধ্যে অনেক স্কুল থেকে অভিভাবকদের ফোন দিয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত সিলেবাস সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে এবং স্কুল খুললেই পরীক্ষায় বসতে হবে বলে জানিয়েছে। শিক্ষার্থীদের উচিত এই সময়ে একটা রুটিন তেরি করা, যেখানে খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা, প্রার্থনা, পিতা-মাতাকে সাহায্য করা, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের সচেতন করা, শরীরচর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের সময়-বিভাজন থাকবে।
এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা সংষ্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং এই সময়ে শিক্ষার্থীদের উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাড়িতে অবস্থান করা;বারবার সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া; হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের অভ্যাস করা;স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা;হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ না করা;জনসমাগমে অংশগ্রহণনা করা; জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে মাস্ক পরা; হাত দিয়ে যতটা সম্ভব কম জিনিস স্পর্শ করা;রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমনসব খাদ্য গ্রহণ করা; মাদক সেবন না করা;করোনা সংক্রমণবিষয়ে নিজে সচেতন থাকা; পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের মোবাইলে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সচেতন করা;সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা;বাবা মায়ের কথা মেনে চলা; নিয়মিত রুটিন মাফিক পড়াশোনা করা;বাসায় যদি অসুস্থ দাদা-দাদি, নানা-নানি থাকেন তাঁদের সেবাযতœ করা এবংতাঁদের কাছে বসে অতীতের গল্প শোনা; সম্ভব হলে পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে ইনডোর খেলাধুলা (দাবা, ক্যারম, ষোল গুটি, লুডু ইত্যাদি) করা;পরিবারে অন্যদেরকাজে সাহায্য করা; নিয়মিত শরীর চর্চা করা (দড়ি লাফ, মুক্ত হাতের ব্যায়াম, জায়গায় দৌড়ানো, বুকডন, ধ্যান করা) ইত্যাদি। বাবা-মারসঙ্গে থেকে বুদ্ধিমত্তা, সাধারণ জ্ঞান ও মেধাচর্চার কাজ করা যেতে পারে। সারাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় স্কাউটস, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটস, রেড ক্রিসেন্ট, ইউওটিসি, রোটারিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে সেখানে যুক্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনসহ অন্যান্য বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা যেতে পারে। দু’একজন বন্ধু মিলে করোনা সচেতনতা বিষয়ক শ্লোগান নিয়ে পোস্টার লেখা উত্তম কাজ হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে যায়, বন্ধু বান্ধব ও সহপাঠীদের সাথে আনন্দফ‚র্তির মাধ্যমে দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে,ফলে তাদের মন-মানসিকতা ভালো থাকে। কিন্তু দীর্ঘছুটি থাকার কারণেশিক্ষার্থীরা বেশ ক্লান্তি ও অস্বস্তি বোধ করছে, এতেতারা মানসিকভাবে ভেঙেপড়ছে এবংগৃহবন্দির মতো জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অবসাদ পরিলক্ষিত হচ্ছে যা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পরিপন্থি।এই সময়ে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো পিতা-মাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে গ্রাম-অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সময়ে বেশি বেশি করে কৃষিকাজে পিতাকে সাহায্য করতে পারো। এতে পরিবার উপকৃত হবে এবং নিজেরা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।
বর্তমানে প্রতিটি পরিবারেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে গেম খেলা, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারইত্যাদির অনুশীলন বেড়ে গেছে। খেয়াল রাখতে হবে, এগুলোর প্রতি যেন শিক্ষার্থীদেরআসক্তি তৈরি না হয়। এসময়ে যাদেরবাড়িতে টিভি দেখা, গান শোনা ও মুভি দেখার সুযোগ রয়েছে, তারা শিক্ষণীয় অথচ আনন্দ দেয় এমন মুভি দেখতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলেছে আকাশ সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে ঘুমের সমস্যা হবে, মস্তিষ্কের অপরিপক্বতা তৈরি হবে,একাডেমিক পারফর্ম্যান্স নিম্মমুখী হবে, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারসহ নানাবিধ মানসিক ও মনস্তাত্তি¡ক রোগ দেখা দিবে।
শিক্ষাপ্রশাসনের একটি আবশ্যকীয় কাজ হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম সম্প্রসারণ করা। ইদানীং ডিস্ট্যান্স লার্নিংয়ের আওতায় অসংখ্য শিক্ষা বিষয়ক অ্যাপস বাজারে রয়েছে যা দিয়ে অতি সহজে বাড়িতে বসে শিক্ষা দান ও গ্রহণ সম্ভব। এছাড়াও গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংআউট মিট, স্কাইপ, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাটফর্ম রয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই শ্রেণিকার্যক্রম চালানো যায়। দৈনন্দিন পাঠ-পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অনেকটা স্বস্তি লাভ করবে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদেরকে বাসায় থাকতে হচ্ছে। সুন্দর ভবিষৎ গড়ার লক্ষ্যে তাদেরকেবাড়িতেই মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা মানুষের নানা দুর্ভোগ, সমস্যা প্রত্যক্ষ করছে। এসব দেখে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সাহস অর্জন করছে। এ পরিস্থিতি দেখে তারা মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে শিখবে, ভবিষতেমানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। এ ছাড়া অভিভাবকরা সারা বছর নানা ব্যস্ততায় থাকার কারণে তাঁদের সন্তানদেরকে সময় দিতে পারেন নাই,এসময়ে একটু কাছ থেকে সময় ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সন্তানকে ভালো মানুষ ও সুনাগরিক তৈরি করার আহ্Ÿান জানিয়েছেন তিনি।
প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে দেশটা আমাদের সকলের। আমরা অতীতেও যুদ্ধ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, সুতরাং কোনো দুর্যোগের কাছে হার মানতে চাই না। অসীম সাহস, সুদৃঢ় একতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা অতীতে যেভাবে বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ¡াসের মতো অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি বর্তমানেও করোনা ভাইরাস নামক এই মহামারি মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। করোনাকে ভয় নয়, জয় করতে হবে।আশাকরি অতি দ্রæতই এই সংকট দূর হবে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে সিলেবাস কমিয়ে এনে, পরবর্তী ছুটিসমূহের সমন্বয় করে, ক্লাস-পরীক্ষা কমিয়ে এনে,শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে হবে। মহামারী করোনা ভাইরাস আমাদেরকে যত দূরত্বেই ঠেলে দিক না কেন, আমরা যদি সচেতন থাকি, মহান আল্লাহর রহমতে অতি দ্রæত এ বিপদ থেকে মুক্তি পাব ইনশাআল্লাহ। আমিন।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply