করোনার শিক্ষা মনে রাখা জরুরি

ড. মো. সবুর খান ::
করোনা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে করোনার ক্ষয়-ক্ষতির চেয়ে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে করোনা আমাদের লাইফস্টাইলকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমরা কেউ কোনোদিন কল্পনা করিনি যে কোনোদিন ভার্চুয়াল কোর্ট বসবে, কিন্তু সরকার অধ্যাদেশ জারি করে ভার্চুয়াল কোর্টের অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের জীবনধারা পরিবর্তনের বড় ধরনের নির্দশন হচ্ছে এই ভার্চুয়াল কোর্ট। ব্যবসায়ী হিসেবে আমি যদি আমার অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করি তাহলে বলতে হয় যে ৩১ বছর ধরে আমি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি, এই ৩১ বছর ধরে আমি চেষ্টা করে আসছি ব্যবসায় অটোমেশন পদ্ধতি ব্যবহার করার। কিন্তু নানা কারণে আমার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতদিন অটোমেশনের আওতায় শতভাগ আনতে পারছিলাম না। তবে এই করোনার সময় শতভাগ সফল হয়েছি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনতে পেরেছি। সন্দেহ নেই, করোনার এই শিক্ষা আমাদেরকে সামনের দিনগুলোত চলতে সহায়তা করবে।
এরপর করোনা যে শিক্ষা দিল সেটা হচ্ছে, আগে আমাদের ব্যবসায়ীদের একটা প্রবণতা ছিল যে, অফিসটা অনেক বড় হতে হবে, লাউঞ্জ থাকতে হবে, মিটিং রুম থাকতে হবে, কনফারেন্স রুম থাকতে হবে ইত্যাদি। অফিস দেখে সবাই যেন মুগ্ধ হয়ে যায়। করোনার সময়ে এসে এই ধারনা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। গত মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুই দিন আমাকে অফিসে যেতে হয়েছে। তার মানে আমার ব্যবসা কী থেমে ছিল? তা কিন্তু নয়। করোনার কারণে যেটুকু ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল তা কিন্তু কাটিয়ে উঠেছি। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উল্টো অনেক লাভ করেছে। সেটার সংখ্যা খুব বেশি নয় যদিও। বলতে পারেন ১০ শতাংশ ব্যবসা উপকৃত হয়েছে এই করোনার সময়ে। এর মধ্যে নতুন কিছু ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
যেটা বললাম, আগে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বিরাট শোরুম প্রয়োজন হতো, অফিস প্রয়োজন হতো। এখন কিন্তু শোরুম না হলেও চলে। এখন শোরুমের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আপনি আপনার পণ্যকে কতটা গ্রহণযোগ্যভাবে তৈরি করতে পারছেন। যে পণ্য তৈরি করছেন সেটার রিভিউ কতটা ভালো আসছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন কাস্টমার পণ্যটা ব্যবহার করে আরেক জনের কাছে রেফার করছে কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
একটু খেয়াল করে দেখুন, এখন প্রায় সবকিছুই অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে শাকসবজি পর্যন্ত অনলাইনে বিক্রি হবে, সেটা কিন্তু আমরা দুই বছর আগেও কল্পনা করতে পারিনি। করোনার আগে হয়তো অনেকে চেষ্টা করেছে কিন্তু এই করোনার সময়ে এসে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্য অর্থনীতি সবকিছুতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। করোনার প্রথম দিকে একমাস আমিও থমকে ছিলাম। ভাবছিলাম, তিলে তিলে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো কী এবার সমস্যায় পড়ে যাবে। আমার একটি প্রতিষ্ঠানেই ব্যয় হয় প্রায় সাত কোটি টাকা। আমার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চল্লিশটি। আমি তো ভাবলাম, একমাসেই আমি দেউলিয়া হয়ে যাব। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবলাম, আল্লাহ পৃথিবীতে কোনোকিছুই অনর্থক দেন না। কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝেন, আমার কাছে মনে হয় করোনা তো আশির্বাদও হতে পারে। কারণ করোনা আমাদেরকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে তোমাকে সতর্ক হতে হবে। তোমার জীবনযাপন সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
একসময় আমাদের বাসায় বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। সেটার সঙ্গে অনেক আবেগ জড়িত ছিল। কেউ ফোন করলে জিজ্ঞেস করতাম কে ফোন করেছিল, কেন ফোন করেছিল, কী বলল এরকম হাজারটা প্রশ্ন। আর এখন কে কাকে কখন ফোন করছে, কখন মেসেজ পাঠাচ্ছে, আমরা কেউ কারও খবর রাখি না। অর্থাৎ টেকনোলজি আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। করোনা এসে সেই দূরত্ব অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে। কারণ মানুষকে বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকতে হচ্ছে। ঘরে থাকার ফলে পরিবারের মানুষদেরকে বেশি করে সময় দিতে পারছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হচ্ছে। আত্মিক দূরত্ব কমছে। এটা করোনার একটি ইতিবাচক শিক্ষা বলে মনে করি।
এবার একটু অর্থনীতির দিকে নজর দেয়া যাক। এই সময়ে রপ্তানি বেড়েছে। রেমিটেন্সও আসছে। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা অনেকেই শুরুর দিকে প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও আমি কিংবা আমার প্রতিষ্ঠান অনেকটাই প্রস্তুত ছিলাম। আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরকে দুই মাস আগে থেকেই বলে আসছিলাম যে, একটা সমস্যা কিন্তু তৈরি হতে পারে।
তো যারা একেবারেই আমলে নেয়নি তারা কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। তবে এখন কিন্তু সবাই কাটিয়ে উঠছে। আর বিনিয়োগ যে একেবারে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এখন বিনিয়োগ হচ্ছে মূলত অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। স্বাস্থ্যখাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বাইরের বিনিয়োগ কিন্তু পাচ্ছে। আমি নিজেও অফার পাচ্ছি হেলথ সেক্টরে বিনিয়োগ করার। কারণ এই করোনা কিন্তু আমাদেরকে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিল, আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতটা নড়বড়ে। সুতরাং স্বাস্থ্যখাত, প্রযুক্তিখাত, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার সিকিউরিটিতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এইসব সেক্টরে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত খাতে। কারণ সেখানে মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। সুতরাং এইখাতে বিনিয়োগে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক।
সমস্যায় রয়েছে আরও এক শ্রেণির মানুষ, যারা প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেয়নি। শেয়ার মার্কেট কিন্তু এই সময়ে জাম্প করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার ফলে এইখাত সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভালো একটা মনোভাব তৈরি হয়েছে। একইভাবে ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাবেন যে এই মহামারির সময়ে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে কারোই কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ তারা আগে থেকেই টেকনোলজি ব্যবহার করছিল। বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিং বেড়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন নগদের মাধ্যমে প্রদান করবে। এটা একটা দারুণ আইডিয়া। শিক্ষকদেও আর কোথাও যেতে হবে না। তারা ঘরে বসেই নিজের মোবাইলে বেতন পেয়ে যাবেন। এই যে বিরাট পরিবর্তন, এটা টেকনোলজির কারণে সম্ভব হয়েছে।
কাজেই বিনিয়োগের ধরণ পাল্টে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর কথা যদি ধরেন, তারা কিন্তু এখন সশরীরে বিনিয়োগ করতে আসবে না। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সগুলো কোনোকিছুই বন্ধ নেই এখন। আগের চেয়ে বরং তিনগুণ বেড়েছে। আগে যেসব প্রোগ্রাম আমরা সশরীরে করতাম এখন সেসব অনলাইনে করতে হচ্ছে। এই সেদিন ভারতের একটা ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে যোগ দিলাম। সেখানে ছয় শোর বেশি একাডেমিশিয়ান যোগ দিয়েছিলেন। কাউকেই সশরীরে যোগ দিতে হয়নি। সবাই অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত ছিলাম। তো, এ ধরনের প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস চালু রাখলেও প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে যদি বলি, করোনার প্রথম দিকে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুগল মিট, জুম ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করেছে। অনেক শিক্ষার্থী ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিয়ে ট্রল হয়েছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টেকনোলজিতে বিনিয়োগ করেছে, সার্ভার বাড়িয়েছে, ক্লাউডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তারা খুব একটা সমস্যায় পড়েনি। আমরা অনলাইনে যেসব ক্লাস পরিচালনা করছি সেসব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মতামত হচ্ছে, তারা ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করার চেয়ে অনলাইন ক্লাস বেশি উপভোগ করছে। আমাদের অনেক শিক্ষক আছেন যাদের দেড় ঘণ্টার ক্লাসে এক মিনিটের জন্যও একজন শিক্ষার্থীও বের হয়ে যায়নি। পুরো ক্লাসে তারা ফোকাসড ছিল। এজন্য একটা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়েছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ যদি ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়, সিস্টেম বলে দেবে সে ক্লাসে নেই। আমরা এমন কিছু এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি, যার মাধ্যমে কেউ যদি ঘাড় ফেরায় বা অন্যদিকে তাকায়, সেটাও সনাক্ত করা সম্ভব। এসব আমরা আগে কিন্তু প্রয়োগ করতে পারিনি। এখন করোনার সময়ে সম্ভব হয়েছে। কাজেই শিক্ষাখাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমরা কোনোদিন কল্পনা করিনি, অনলাইন শিক্ষাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী অনুমোদন দেবেন। করোনার কারণে সরকার কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন শিক্ষাকে অনুমোদন দিয়েছে। সরকার বিটিভি, বাতায়ন ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এধরনের অনেক সুযোগ তৈরী হয়েছে। আগামীতে এ ধরনের সুযোগ আরও তৈরী হবে। ভবিষ্যতে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়বে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ল্যাবভিত্তিক যেসব শিক্ষা ছিল সেসবের কী হবে। এখানেও কিন্তু স্টিমুলেশন সফটওয়্যার, থ্রি ডি ইফেক্ট সফটওয়্যার চলে এসেছে। এসব ব্যবহার করে ল্যাব ক্লাসও করা সম্ভব। সুতরাং সফটওয়্যার খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। জুম সফটওয়্যারের কথাই ভাবুন। এই করোনার আগে তার নাম কে জানত? এখন জুম পৃথিবীর অন্যতম জায়ান্ট কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। করোনার এইসব শিক্ষা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে।
তারপর পত্রিকার কথা ধরুন। আমি ভুলেই গেছি শেষ কবে ছাপা পত্রিকা পড়েছিলাম। কারণ অনলাইনেই সব পড়া যায়। সাংবাদিকরা মোবাইল ফোনেই ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। তার রেকর্ড থাকছে। টেলিভিশনের প্রোগ্রামগুলোও সেভাবেই তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম দিকে একটু সমস্যা হয়েছে। এখন সবাই এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। প্রত্যোক সেক্টরেই পরিবর্তন আসছে এবং ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তন আসবে। হোটেল ব্যবসা যারা করেন তারাও কিন্তু ব্যবসায় পরিবর্তন আনছেন। তারা এখন বলছেন, কেউ যদি হোটেলে সিট বুকিং দেয় তার যাবতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার রাখা হচ্ছে। আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও মিনি হাসপাতাল তৈরি করছি। এসব কিন্তু আগে ছিল না। করোনা আমাদেরকে বাধ্য করেছে এইসব উদ্যোগ নিতে।
তবে একটা কথা আছে। এই যে এতসব পরিবর্তন, এই পরিবর্তনগুলো কিন্তু উন্নত দেশগুলোতেও ঘটেছে। পার্থক্য হচ্ছে, আন্তজার্তিক স্ট্যান্ডার্ডে আমরা এখনো কিছুটা পিছিয়ে আছি। তবে আমার মনে হয়, আমাদের সময় এসেছে নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রমাণ করার। আমাদের ছেলেমেয়েরা বেশ কিছু ভালো ভালো পণ্য, সাপোর্ট সার্ভিস তৈরি করেছে যেগুলো দেশের বাইরেও ব্যবহৃত হচ্ছে। নব্বই দশকে আমি যখন ব্যবসা শুরু করি তখন আমি ছিলাম টেকনোলজিতে সেরা। এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে আমি কিন্তু কিছুই না। তারা টেকনোলজিতে অনেক ফার্স্ট। এই প্রজন্মের সামনে সুযোগ অনেক বেশি। এই প্রজন্মের জীবন শুরুই হয়েছে মোবাইল দিয়ে। তারা এখন প্রযুক্তির জ্ঞানের দিক থেকে অনেক উন্নত। কাজেই তরুণ প্রজন্মের জন্য এখন একটা বিরাট সুযোগ এসেছে বিশ্বব্যাপী নিজেদেরকে প্রমাণ করার। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এই প্রজন্ম অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদেরকে প্রমাণ করতে পারবে।
টেকনোলজি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে প্রভাবিত করছে সে সম্পর্কে একটু বলি। টেকনোলজি তরুণ প্রজন্মের কাছে আশির্বাদ হিসেবে এসেছে। আগে তরুণ প্রজন্মের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হতো রাজপথ থেকে। এখন শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন শাহবাগ আন্দোলন বলেন আর অন্য যেকোনো আন্দোলন বলেন, সেসব আন্দোলনে কিন্তু টেকনোলজিও বড় ভূমিকা রয়েছে। এখন যে নারী নিপিড়নবিরোধী আন্দোলন চলছে, এর পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার। এক সময় রাজনীতি ছিল মাঠে। এখন রাজনীতিও চলে এসেছে টেকনোলজিতে। রাজনীতিবিদদের জনপ্রিয়তাও এখন প্রমাণ করতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ডোনাল্ড ট্রাম, নরেন্দ্র মোদি সকালে ঘুম থেকে উঠেই টুইট করেন। তুরষ্কের এরদোগানের কথাই ভাবুন। আর্মিরা ক্যু করে ফেলেছিল। তিনি কোনো এক হোটেলে থেকে ফেসবুকের লাইভে এসে সম্পূর্ণ ক্যুকে নসাৎ করে দিলেন। টেকনোলজি তাকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
সুতরাং টেকনোলজির ক্ষমতা অস্বীকার করার আর উপায় নাই। সরকারও এটা উপলব্ধি করতে পারছে। ফলে সরকারবিরোধী যে কোনো মন্তব্য, প্রচারণা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ভবিষ্যতে যারা রাজনীতি করতে আসবেন তাদেরকে টেকনোলজি ব্যবহার করেই রাজনীতি করতে হবে। এটাও রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তন। মিশরের কথা ভাবুন। মিশরে সরকার পরিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র ফেসবুকের কারণে। মিশরের তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল সেটা কিন্তু ফেসবুকের মাধ্যমে দিয়েছিল। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার কথা ভাবুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনাটা না এলে কিন্তু এটার কিছুই হতো না। এসব যেকোনো একটা ঘটনা কিন্তু সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এখন কেউ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কথা বলে, জনগণের দাবি দাওয়ার কথা বলে, ভালো ভালো কথা বলে, মানুষ তার পেছনে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ার মতো দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই ফিল্ড রাজনীতি এখন খুব কম। পুরো রাজনীতিই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে টেকনোলজির মাধ্যমে।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের সফলতা ব্যর্থতা নিয়েও নানা আলোচনা কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতেই হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকার কিন্তু জান প্রাণ দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যারা উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করবেন তারা যদি অবহেলা করেন, দুর্নীতি করেন সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। মূল সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের। সুশাসন নিশ্চিত না করার ফলেই হাজারটা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সরকারের উদ্যোগগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যখন বাস্তবায়ন করা হয় তখন তদারকিটা ঠিকমতো হয় না। সমাজে ভালো মানুষও আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন একজনকে চিনি, যিনি ট্যাক্স অফিসে ফোন করে বলেন, প্রয়োজন হলে আমার কাছ থেকে অগ্রীম ট্যাক্স নিয়ে রাখুন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এইসব মানুষদেরকে সঠিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সবশেষে এটুকু বলি, কোভিড-১৯ আমাদেরকে যে বার্তাটুকু দিল সেটা হচ্ছে, আমাদেরকে আরও মানবিক হতে হবে, মানুষের মর্যাদা দিতে হবে, স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হবে, খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে হবে। করোনার এইসব শিক্ষা আমাদের মনে রাখা জরুরি।
লেখকঃ ড. মো. সবুর খান, চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply