করোনা আমাকে লিখতে বসালো : ভ্রমণ কাহিনী

অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা ::

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ পড়ে আমার দেশ-বিদেশ ভ্রমনের ইচ্ছে জাগতো প্রবল। সময়, সংসার, বাচ্চা, অর্থ, সবমিলিয়ে হয়ে উঠেনি। ভ্রমণ কার না ভাল লাগে? বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন জায়গা দেখা, তাঁদের ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পোশাক, খাবার সব কিছু সম্পর্কে জানা আনন্দের, রোমাঞ্চকরও বটে।
বাংলাদেশে ভ্রমণ করার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পন্ডিত প্রায় সব জায়গাগুলো দেখার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভারতের দর্শনীয় ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে বেড়াবো। সে লক্ষ্যে ২০০১ সন থেকে ভ্রমণ শুরু। একে একে লিখবো মজার সব অভিজ্ঞতা ও কাহিনী।
আজকের লিখা ভারতের সিমলা, কুল্লু, মানালী ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ।


আমরা হাইকোর্টে প্রেকটিসরত চারজন আইনজীবী এবং সাথে বন্ধু লুসি ও মেয়েকে নিয়ে তৈরী প্রমিলা ট্যুর গ্রুপ। এখানে শুধুই ছয়জন নারী মিলেই শুরু করেছিলাম যাত্রা।
অনেক দিন থেকে মনে খুব ইচ্ছে কাছাকাছি কোন বরফের দেশে যাবো, বরফে গড়াবো, বরফ দিয়ে বল বানিয়ে ছুড়ে মারবো, তৈরী করবো বরফের পুতুল। এ ইচ্ছে নিয়েই যাত্রা শুরু হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা বেড়ানো। সাথে কুল্লু মানালী। মার্চ মাসের ছুটিকেই আমরা বেছে নিয়েছি বেড়ানোর মোক্ষম সময় হিসেবে। আর তাই হুট করে প্লেনে আকাশ দেখে চলে যাওয়া নয়, আমরা যাবো আস্তে আস্তে। দেখবো অন্তর ভরে। সঞ্চয় করবো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
রাত এগারোটার শ্যামলী পরিবহনে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম প্রমীলা অভিযাত্রীর দল।। পরদিন সকাল ১১টায় কলকাতায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটায় আমরা রাজধানী এক্সপ্রেস যাত্রা করলাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে।
দিল্লীতে একজন ট্রাভেল এজেন্ট রাজা বাবু আমাদের আত্মীয়ের মতো হয়ে গিয়েছিলেন কয়েকবার ওনার আতিথেয়তায় থাকার সুবাদে। আমরা উঠলাম দিল্লীতে কেরল বাগ রাজা বাবুর হোটেল রেডিয়েন্সে।
সারাদিন হোটেলের আশে পাশে ঘুরাঘুরি করে আমরা ঢাকা থেকেই কালকা মেইলে টিকেট করে রেখেছিলাম আগেই। তাই রাত ১১টায় আমরা কালকা মেইলে যাত্রা শুরু করলাম।
উত্তেজনা মনে অজানার উদ্দেশ্যে ছয়জন মেয়ে চলছি। চিনিনা-জানিনা। ভাষাও খুব একটা বুঝতে পারিনা। মনে মনে ভয়। কিন্তু সঙ্গীদের খুব সাহস দেখাচ্ছি।
ঝিক ঝিক ট্রেন চলছে তো চলছে। রাজধানী এক্সপেসের মতো টু টায়ার হলেও কালকা মেইল অতোটা উন্নত মানের ছিলোনা। এক সময় আমাদের কামরায় পুলিশ এলো এসে বলে “আপ সব আওরাত হায়”?
মনে একটু ভয় হলো। কেননা ওই সময়ে দিল্লীতে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছিল অনবরত।। পুলিশ জেনে গেলো এখানে শুধু মেয়েরা। আমি আস্তে আস্তে ফল কাটার ধারালো ছুরিটা বের করে হাতের কাছে রাখলাম। ডলার, পাসপোর্টসহ সব মূল্যবান অর্নামেন্টসগুলো সেইফ করে রাখলাম।
রাত পাঁচটার দিকে দেখি আমাদের ট্রেনটি যেন ঘূর্ণন দিচ্ছে। ঝালমুড়ি, চানাচুর বিক্রেতা যেভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মশলা দিয়ে ঝালমুড়ি বানায় ট্রেনটিও আমাদের এভাবেই বানাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, এ বুঝি উপর থেকে পরেই যাবো। পরে বুঝেছি- ট্রেনটি আকাঁবাকা পাহাড়ি ঘূর্নিয়মান রাস্তা ধরে যাচ্ছিল বলেই এ অবস্হা।
একসময় ট্রেন স্মুথলি চলা শুরু করলো ট্রেন চলে ঝিক, ঝিক,ঝিক, ঝিক আমরাও হাসাহাসি করি ফিক ফিক ফিক।
রাতে কিছুক্ষণ পরপরই রেলপুলিশ এসে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি। এটা ছিল পুলিশের অতি সতর্কতা। শুধুই অবলা নারী মনে করেই নজর বুঝি একটু বেশীই ছিলো। নারীর হাতে কিন্তু রেডি ছুরি।
সকাল সাতটায় পৌঁছে গেলাম কালকা স্টেশনে সেখানে রাজা বাবু আমাদের ছয় জনের জন্য আট সিটের বড় এক গাড়ি পাঠিয়েছেন। সে গাড়িতে করে আমরা পৌঁছালাম আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেলে।।
হিমাচল প্রদেশের রাজধানীতে সিমলা প্রকৃতি রাণী। আর তাই রাণীকে সাজানো হয়েছে যেন তার অপার সৌন্দর্য ঢেলে। এখানে মাটির নীচ থেকে হোটেল উপরের পাচঁতলায় মেইন রাস্তা অবধি। পিছনে বনবনানী, পাহাড় বাড়ি-ঘর। হোটেল রুমে বিশ্রাম নিচ্ছি। পর্দা সরিয়ে দেখি হনুমান চারপাঁচটি তার বাচ্চাদের নিয়ে বারান্দায় বসা। হনুমান তার সন্তানদের আদর করে কলা খাওয়াচ্ছে । ভয় পেয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানের প্রতি তাদের ভালবাসা মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। মনে হলো- সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের ভালবাসা মানুষ ও পশু পাখিদের একই কোন পার্থক্য নেই। আমার মনটাও আমার সন্তানদের জন্য মোচড় দিয়ে উঠলো।
দুপুরের খাবার সেরে বেরিয়ে গেলাম সিমলার দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখার উদ্দেশ্য। পাহাড়ের কোল ঘেসে আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে চলছে আমাদের নিজস্ব গাড়ি। প্রকৃতি এতো সুন্দর সাজে সাজতে পারে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। আর বিধাতা পৃথিবীতে এতো সুন্দর করে সাজাতে পারে?
শৈল শহর সিমিলার জাকুটা মন্দির দেখে চলে গেলাম কুফরী তে। সেখানে রয়েছে এক রোমাঞ্চ। বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ে অবগাহন করলাম। হেলে দুলে টগবগিয়ে চলছে ঘোড়া, আমরা ঘোড়ায় চড়ছি। নিজকে জমিদার জমিদার মনে হচ্ছিল। সাথে রবিঠাকুরের কবিতা মনে পরে গেল।
“মনে হলো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
আমি যাচ্ছি রাঙ্গা ঘোড়ার পরে।”
কিন্তু খারাপ লেগেছে বড় বড় পাথরের নূড়ির উপর পিচ্ছিল কাদার উপর শুকনো,রোগা ঘোড়ায় চড়িয়ে মানুষকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। অমানবিক মনে হয়েছে।।
পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পাথরের উপর শুকনো ঘোড়াগুলো যখন অনেক দূর আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল এই বুঝি পাহাড়ের গায়ে আমিও পা পিছলে পরে যাবো।
পয়সা আয়ের জন্য পশুগুলোর সাথে অমানবিক আচরণ আমাকে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদে পূর্ণ করে দিয়েছিলো। টগবগ, টগবগ ঘোড়া চড়া শেষ করে সন্ধ্যার পূর্বে ফিরছি আর প্রান ভরে হৃদয় ভরে দেখছিলাম “গ্রীণ ভ্যালী”। সবুজে সবুজ তুমি নীলিমায় নীল। যেন এক সবুজ অঞ্চল। চোখ ফেরানো যায় না। কি অনাবিল সৌন্দর্য্য। সবুজ পাহাড় যেন মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রেখেছে প্রকৃতি রাণী সিমলাকে। পরে আপেল ভ্যালী দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম হোটেলে। রাতে আড্ডা দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেলাম আগামী কালের যাত্রা কুল্লু মানালীর উদ্দেশ্য।
-চলবে

লেখক : অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
সভাপতি : ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা আইনজীবী কল্যাণ সমিতি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply