চির নিদ্রায় শায়িত সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী

ইব্রাহীম রনি :
মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও চাঁদপুর জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী (৮৫) আর নেই। ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ৮টায় তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল -সিএমএইচে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না…রাজেউন।
এ তথ্য জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আবুল বাশার।
তিনি জানান, তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই নানা রোগে ভুগছিলেন। পরে গত ৩০ আগস্ট তাকে সিএমএইচে ভর্তি করানো হলে তার করোনা পজেটিভ আসে। এর তিন দিন পর আবার তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
তিনি জানান, বাদ আছর ক্যান্টম্যান্ট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনীর শ্রদ্ধা নিবেদনশেষে তার মরদেহ বনানী বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।


জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি অ্যাড. আব্দুল হামিদ, স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনরা।
উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আবু ওসমান চৌধুরী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন।
১৯৬০ সালে কুমিল্লার মৌলভী পাড়ার মনসুর আহম্মেদের বড় মেয়ে নাজিয়া খানমের সঙ্গে আবু ওসমানের বিয়ে হয়। নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান তাদের দুই মেয়ে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়, সেই খবর আবু ওসমান পান কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে বসে। সে সময় তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চতুর্থ উইংয়ের কমান্ডার হিসেবে চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বে।
পরদিন সকালে তিনি কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে একদল সৈনিককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে আবু ওসমান চৌধুরী এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন।
তার স্ত্রী নাজিয়া খানমও সে সময় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খাবার ও পানীয়, টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়া এবং প্রয়োজনে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দেওয়ার মত কাজ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবু ওসমান চৌধুরীকে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের সময় একদল সেনসদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে হামলা করে। বাড়িতে না থাকায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তার স্ত্রী নাজিয়া খানম।
পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। বর্তমানে তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে আছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবু ওসমান চৌধুরীকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান করা হয়। পরে তাকে চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।

শেয়ার করুন

Leave a Reply