পূর্ববর্তী উম্মতের রোজা

মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম ::
কুরআন মাজিদের সুরা বাকারার ১৮৩তম আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর।’ তাফসীরে রূহুল মায়ানীতে ‘পূর্ববর্তী লোকদের ওপর’ বাক্যটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে হযরত ঈসা আ. পর্যন্ত সকল উম্মত এবং শরিয়তেই যেমনি নামাজের ইবাদত থেকে বাদ ছিল না, তেমনি রোজাও সকলের জন্যে ফরজ ছিল। অবশ্য এ কথা দ্বারা এ তথ্য বোঝায় না যে, আগেকার উম্মতদের রোজা সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতির দিক দিয়ে আমাদের ওপর ফরজকৃত রোজারই অনুরূপ ছিল। কারণ আগেকার উম্মতদের রোজার সময়সীমা এবং সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তবে হ্যাঁ, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আগেকার উম্মতদের ওপরও রোজা ফরজ ছিল।
আগেকার উম্মতদের রোজা কেমন ছিল- তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া মুশকিল। তারপরও পূর্ববর্তী উম্মতদের রোজার ধরন সম্পর্কে বুখারি এবং অন্যান্য হাদিসের কিতাবের উদ্ধৃতিতে তাফসিরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ রয়েছে- আগেকার যুগে রাতে নিদ্রা যাওয়া থেকেই রোজার ফরজ শুরু হয়ে যেত। ইফতারের পর থেকে শয্যাগ্রহণের পূর্ব পর্যন্তই শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। শয্যাগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই এসব কিছু হারাম হয়ে যেত।
একবার কায়েস বিন সালমাহ আনসারী রা. রোজা রেখে ইফতারের সময় ঘরে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, খাওয়ার কিছু আছে কি? স্ত্রী বললেন, নেই। তবে দেখি কোথাও থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনা যায় কিনা। এদিকে সারাদিনের কর্মজনিত ক্লান্তিতে কায়েসের চোখে ঘুম চলে আসল। স্ত্রী ফিরে এসে দেখলেন স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফলে ঐদিনের ক্ষুধা নিয়েই তাকে পরের দিনের রোজা থাকতে হলো। এ সকল আলোচনার দ্বারাই প্রতীয়মান হয় যে, রোজার ধরন ও সময়ের পার্থক্য হলেও পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ ছিল। নিচে পূর্ববতী যুগে কোন নবির উম্মতদের ওপর ক’দিনের রোজা ফরজ ছিল, তা’ ঐতিহাসিক সূত্র হতে তুলে ধরা হলো।
হযরত আদম আ.-এর যুগের রোজা : আল্লাহ তায়ালা আদি মানব হযরত আদম আ.কে সৃষ্টি করে প্রথমেই বেহেশতে থাকতে দেন। পরে এক বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে আদম ও হাওয়া উভয়কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। যেদিন তারা দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, সেদিন ছিল মহরম মাসের দশ তারিখ। পৃথিবীতে আগমন দিবসে চতুর্দিকে কোনো খাদ্যসামগ্রি না পেয়ে উভয়ে রোজার নিয়ত করে নেন। ইতিহাস গ্রন্থের ভাষ্যমতে, তারা সামান্য অপরাধের জন্য দীর্ঘ সাড়ে তিনশ’ বছর পর্যন্ত ওপরের দিকে মুখ না তুলে অবনত মস্তকে কাঁদতে কাঁদতে কাটিয়ে দেন। এ দীর্ঘ সময়ে তাদের ক্রন্দনরোল ব্যতীত অন্য কোনো কার্যসম্পাদন করার প্রমাণ উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিহাসগ্রন্থে পাওয়া যায়নি। সে হিসেবে মুফাসসিরগণ বলেছেন, এ সুদীর্ঘ সময়ই তাদের রোজা অবস্থায় কেটেছে। রাতে সামান্য আহার গ্রহণ করে একটু ঘুমিয়ে নিয়েই পুনঃতাহাজ্জুদের সময় থেকে তাদের ক্রন্দন বিলাপ চলতে থাকত। তাদের তওবা কবুল হওয়ার পর আদম আ.-এর ঔরসজাত উম্মতদের জন্য তাদের পৃথিবীতে আগমন দিবস ও তওবা কবুল দিবসে শোকরিয়া স্বরূপ রোজা রাখার প্রথা চালু হয়।
হযরত ইবরাহীম আ. যুগের রোজা : রমজান মাসের ১লা তারিখে হযরত ইবরাহিম আ.-এর ওপর সহিফা অবতীর্ণ হয়। তাই সেদিনকে স্মরণে রাখার জন্য তার উম্মতদের ওপর ১ তারিখের পাশাপাশি আরও দু’দিনসহ ১, ২ ও ৩ রমজানের রোজা ফরজ ছিল। একই সাথে তিনি যেদিন খোদাদ্রোহী শাসক নমরুদের অগ্নিকুÐ হতে মুক্তি পান, সেই স্মরণীয় দিবসে রোজা রাখাও তাঁর উম্মতদের ওপর ফরজ ছিল। সর্বশেষ স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে কুরবানি দেয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প যেদিন বাস্তবায়ন করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক দিবসকে স্মরণীয় রাখতে ঐ দিবসের পূর্ববর্তী তিন দিন রোজা রাখা তাঁর ও তৎপরবর্তী নবি ইসমাঈল ও ইসহাস আ.-এর উম্মতদের জন্য ফরজ ছিল। ইসমাঈল আ.-এর উম্মতদের সর্বমোট রোজা ছিল ৭টি।
হযরত দাউদ আ. যুগের রোজা : ১২ রমজান দাউদ আ.-এর ওপর আসমানি কিতাব যাবুর অবতীর্ণ হয়। এছাড়া প্রত্যেক শনিবার তিনি সমুদ্রের কূলে বসে সুমধুর কণ্ঠে যাবুর কিতাব তেলাওয়াত করতেন। তার সুরের মূর্ছনায় সমুদ্রের মাছ তীরে ভেসে ওঠে এবং পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ বন্ধ করে গাছের ডালে বসে নীরবে তেলাওয়াত শুনত। সে হিসেবে যাবুর কিতাব নাজিলের মাস রমজানে তিন দিন এবং প্রতি শনিবার তার উম্মতদের ওপর রোজা রাখা ফরজ ছিল।
হযরত মুসা আ.-এর যুগের রোজা : হযরত মুসা আ. নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে তুর পর্বতে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথা বলতেন। এজন্য তাকে ‘কালীমুল্লাহ’ উপাধি দেয়া হয়েছে। একবার তিনি আল্লাহর দরবারে আসমানি কিতাব প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তাঁকে এ কিতাবপ্রাপ্তির জন্য দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করার নির্দেশ দিলেন। তিনি আল্লাহর অনুমতিক্রমে নিজ ভাই হারুণকে নবুয়তির দায়িত্বে স্থলাভিষিক্ত করে দীর্ঘ একমাস তুর পর্বতে গিয়ে সাধনা করেন এবং রোজা রাখেন। নির্দিষ্ট দিন আসলে বিশেষ কৌশলে আল্লাহ তাঁকে আরও দশ দিন রোজা রাখার জন্য নির্দেশ দেন। সর্বমোট চল্লিশ দিন তিনি রোজা রাখার পর তার প্রতি রমজান মাসের ৬ তারিখে তাওরাত কিতাব একত্রে নাজিল হয়। তাই বিশেষত্ব ব্যতীত শুধু একমাস সিয়াম সাধনা করা মুসা ও হারুন আ.-এর উম্মতদের ওপর ফরজ করা হয়। এছাড়া মুসা আ. খোদাদ্রোহী শাসক ফেরাউনের যাদুকরের সাথে বিজয় অর্জন ও দলবলসহ নীলনদ পার হওয়ার পর প্রতি বছর ঐ দিবসে তার উম্মতদের জন্য শোকরিয়া হিসেবে এ দুটি রোজা রাখা নফল বলে গণ্য ছিল। এ হিসেবে বলা যায়, আমাদের নবি মুহাম্মদ সা. ও মুসা আ.-এর উম্মতদের জন্য এক মাসের রোজা ফরজ। তবে আমাদের বর্তমান রোজার ন্যায় মুসা আ.-এর উম্মত রোজার ধরন ছিল না।
হযরত সুলায়মান আ.-এর যুগের রোজা : হযরত সুলায়মান আ.-ই একমাত্র নবি যিনি পৃথিবীর সকল মাখলুকাতের ভাষা বুঝতেন। আগুন, পানি, বাতাস, মাটিসহ গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি সকল কিছুর কথা তিনি বুঝতে পেতেন। এজন্য সুলায়মান আ. নিজে সারা বছরই শোকরিয়া হিসেবে রোজা রাখতেন বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। কিন্তু তাঁর উম্মতের ওপর নির্দিষ্ট ক’টি রোজা ফরজ ছিল, এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কোনো কোনো সূত্রে তার উম্মতের ওপর ৯টি রোজা ফরজ ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
হযরত নূহ আ.-এর যুগের রোজা : হযরত নূহ আ.-এর উম্মতের ওপর প্রতি বছর চল্লিশটি রোজা ফরজ ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হযরত নূহ আ. দীর্ঘ সাড়ে ৯শ’ বছর পর্যন্ত মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দেওয়ার পরও যখন মানুষ খোদার পথে আসল না; তখন আল্লাহ তায়ালা নাখোশ হয়ে মানুষের ওপর মহাপ্লাবন নামক গজব আপতিত করেন। সে সময় সকল প্রাণীজীবের একেক জোড়া ও মাত্র ঈমানদার ৪০ জন মানুষ বিশেষ জাহাজে আত্মরক্ষা করেন। এছাড়া পৃথিবীর সকল প্রাণীই দীর্ঘ ৪০ দিনের স্থায়ী প্লাবনে মারা যায়। পরবর্তীতে ঐ চল্লিশ দিনকে স্মরণীয় রাখার জন্য তার উম্মতদের ওপর ৪০ দিনের রোজা ফরজ করা হয়।
হযরত ইউনুস আ.-এর যুগের রোজা : হযরত ইউনুস আ. একবার ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে যান। এ সময় একটি বিশালাকৃতির মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। দীর্ঘ চল্লিশ দিন তিনি ঐ মাসের পেটে পানাহারহীন অবস্থায় আল্লাহর বিশেষ কৃপায় বেঁচে থাকেন। ঐ চল্লিশ দিন তিনি মাছের পেটে থেকে রোজা রেখেছেন বলে তাফসিরগ্রন্থ সূত্রে জানা যায়। তবে তার উম্মতের জন্য ফরজ রোজা ছিল সাতটি।
হযরত ইউসুফ আ.-এর যুগের রোজা : হযরত ইউসুফ আ. মাত্র টগবগে কিশোর। এ সময় তার এগারো ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি অন্ধকার কূপে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চল্লিশ দিন যাবত তিনি কূপে পড়ে আল্লাহ্কে ডাকতে থাকেন এবং ঐ সময়ে তিনি রোজা রাখেন। তাঁর উম্মতের জন্য ঐ দুঃখের অংশীদার হতে সেই চল্লিশ দিনের রোজা ফরজ ছিল। তবে কোনো কোনো গ্রন্থসূত্রে পাওয়া যায়, তাঁর উম্মতের জন্য একাধারে চল্লিশ দিন রোজা রাখার বিধান মাত্র একবারই আবর্তিত হয়। অন্য বছরগুলোতে তিনটি রোজা ফরজ ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
হযরত ঈসা আ.-এর যুগের রোজা : ১৮ রমজান হযরত ঈসা আ.-এর ওপর পবিত্র ইনজিল কিতাব অবতীর্ণ হয়। এছাড়া তিনি নবি থাকাকালে আমাদের যুগের ‘হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’ একটি মাত্র রজনী লাইলাতুল কদরের ফজিলত জানতে পেরে ১৮ রমজান থেকে সেই মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখতেন। এ রোজা তাঁর উম্মতের ওপরও ফরজ ছিল। অপর এক সূত্রে জানা যায়, হযরত ঈসা আ. জন্মগ্রহণ দিবসে মুখে দুধসহ কোনো খাবার নেননি। পরে তৎকালীন আলেমদের ব্যাখ্যামতে জানা যায়, হযরত ঈসা আ. রোজা মুখেই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।
শুধু ইসলাম ধর্ম কিংবা আসমানি কিতাবপ্রাপ্তদের ওপরেই নয়, অন্যান্য ধর্মেও রোজার প্রচলন ছিল। এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটনিকার একাদশ সংস্করণের ১৯৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানেই স্বীকৃত আছে। ভারত অধিবাসী ব্রাহ্মণদের জন্য প্রতি মাসের ১১ ও ১২ তারিখে একাদশীয় উপবাস; যোগীদের জন্য ৪০ দিনব্যাপী উপবাস ছাড়াও বহু ধরনের উপবাসের সন্ধান মেলে হিন্দুধর্মে। জৈন ধর্মাবলম্বীরা তাদের বার্ষিক আরাধনাকালে কয়েক সপ্তাহব্যাপী উপবাস পালন করে থাকেন। বৌদ্ধধর্মে পানাহার বর্জন করে যথাবিহিত উপবাসযাপন করা ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ। প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও রোজা বা উপবাস প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। ফার্সিয়ান ধর্মে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচশালা উপবাসব্রত অবশ্য পালনীয় ছিল। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে হিসমোফেরিয় মাসের তৃতীয় দিবসে কেবলমাত্র নারীদের জন্য রোজার বিধান ছিল।
তাফসিরে ইবনে কাসীরের মতে, সমস্ত আসমানি কিতাবই রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। আর আমরা জানি আসমানি কিতাব ১০৪টি। সুতরাং এ হিসেবে বলা যায়, অন্তত ১০৪ জন নবির উম্মতের জন্যই রমজান মাসে কোনো না কোনো রোজা ফরজ ছিল। এ জন্যই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর।’

লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স

শেয়ার করুন

Leave a Reply