ফজর আলীর কোরবানির ঈদ

-মোঃ মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী
প্রাক্তন সিনিয়র সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়

রহিমুদ্দি গেটের কলিং বেল টিপলেন বার দুয়েক। কোন সাড়াশব্দ নাই। আবারও কলিং বেলে টিপ। একইসঙ্গে ক্ষীন কন্ঠে আহ্বান-“ও ফজর আলী ভাই, আপনি কি গুমাইতেছেন ? সামান্য একটু কথা ছিল।” বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পর ভিতর থেকে আধা-ঘুম অবস্থার আওয়াজ।
– “কে কে ?”
রহিমুদ্দির কলিজায় পানি এসেছে। একটু খুশিখুশি ভাব। যাক, এবার ভাইয়ের দেখা মিলবে। মন খুলে দুই চারটা কথা বলতে পারবে। তাতে তিনি যদি একটু মুখ তুলে তাকান, সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটবে।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে রহিমুদ্দি লম্বা করে ফজর আলীকে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়ে ফরজ আলী ঘুমের আড়মোড়া ভাব ভেঙে বলে উঠলো- আরে রহিমুদ্দি যে। ভালো আছো? এতো সাত-সকালে চলে আসলে। ভিতরে আসো।
রহিমুদ্দি নিজেও একজন মোটামুটি ব্যস্ত মানুষ। বাড়ির পাশেই ছোট-খাটো ব্যবসা করে। খেত-খামার আছে, পুকুরে মাছ চাষ করে। যা আয় হয় ভালোভাবেই সংসার চলে যায়। তার নিজের ঘরটা অতো সুন্দর এবং ছিমছাম না। কিন্তু ফজর আলীর রুচিবোধ আছে। ঘরের ড্রয়িং রুম জুড়ে বেশ সুন্দর সোফাসেট, মাঝারি সাইজের একটি টিভি। আলমারিতে বেশ দামী কিছু বাসনকোসন। উপরের তাকে কোরআন শরিফ। একনজরে মন কেড়ে নেয়। মনে মনে ভাবে- সেই ফজর আলী আর এই যুগের ফজর আলী এক নয়। সে নিরক্ষর। কিন্তু ভালো পরিবেশে থাকতে থাকতে এখন কিছু কিছু শুদ্ধ ভাষা শিখে ফেলেছে। আর কোথায় ফজর আলী ভাই আর কোথায় গ্রামের সাধারণ রহিমুদ্দি। দুজনের পার্থক্যও অনেক ।

-তো রহিমুদ্দি কি মনে করে আসলা ? জরুরি কোন বিষয় আছে নাকি?
– না। তেমন জরুরি না। ভাই, এতো সকালে আপনার ঘুম নষ্ট করলাম।
-না-না। অনেক রাইতে ঘুমাইছিলাম। সকালে ফরজ নামাজ এবং কোরআন শরিফ পড়ে এক ছালা ঘুম দিলাম। হাতে কাজ নাই। তাই একটু আরাম করলাম।
-খুব ভালো করেছেন। কতো আর কাজ করবেন ? সেই ছোট কাল থেকে কলুর বলদের মতো কী কষ্টটাই করেছেন। মানুষ সারাজীবন কষ্ট করে না। এক কালে সুখ আসে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার দিকে তাকিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! অনেক সুখেই আছেন। এক নাগাড়ে কিছু দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থন করলো রহিমুদ্দি।
ফজর আলীর থেকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছোট রহিমুদ্দি। পাশাপাশি বাড়ি। এক গ্রামের মানুষ চৌদ্দ গ্রামের মানুষের ইতিবৃত্ত জানে, প্রতিবেশির হাঁড়ির খবরও জানে।
– ভাই,শরীরটা ভালো আছে-তো?
-অতো খারাপ না। মাঝে মাঝে একটু প্রেসার বাড়ে, হাঁটুতে জোর কম পাই। ঘাড়ে-পিঠে-মাজায় ব্যথা হয়। ছেলে, বউমা, নাতি-নাতিনদের অত্যাচারে বাঁচি না। কেবল ডাক্তার, ডাক্তার। ডাক্তারের পিছনে কতো টাকা-পয়সা খরচ হইতেছে। টাকার জন্য কত মায়া লাগে ? খরচ করতে কি মন চায় ? আহারে! আমার বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজনরা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। গরীবের সংসার ছিল । নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। খাইতেই পারতাম না। আবার চিকিৎসা ? আর এখন বয়স হইছে না । এই বয়স-তো আমার বাপ-মা কেহই পায় নাই। না খাইয়া, না পইরা, মানুষের জমিতে কাজ কইরা জীবনডাই শেষ কইরা দিছি। সেই হিসাব করলে অনেক ভাগ্যবান। আল্লাহর কাছে শোকর হাজার বার। আরও বললো,
-শোন রহিমুদ্দী অনেক সময় মনের মানুষও পাওয়া যায় না। তাই শৈশব-যৌবন কালের অমানুষিক পরিশ্রম আর দুঃখ-কষ্টের কথা কার সঙ্গে বলবো ? নাতি-নাতনি আর ছেলেদের এখন শুনার সময় নাই, তাদের তেমন আগ্রহও নাই এবং ঐসব কথা তারা বিশ্বাসও করে না। নাতিদের দোষই বা কি? অভাব যে কী জিনিস তারা চোখে দেখে নাই। দুখীর দুঃখ বুঝবে কিভাবে?
কাছের মানুষ রহিমুদ্দিকে পেয়ে পুরনো স্মৃতি উদগিয়ে উঠলো ফজর আলীর। সে বলতে লাগলো,
– এই-তো সেই ৯৭ কিংবা ৯৮ সনের কথা। দেশের কতো জোয়ান ছেলেরা মিডল ইস্টে গেছে । বস্তা বস্তা টাকা পাঠায়। ঐ দেশ যেন টাকার খনি। সেই টাকায় জমি-জিরাত কিনে, ঘর বানায়, ভাগ্য খুলে যায়। একদিন বাজারে টিভিতে “টাকা দেন দুবাই যাই ” নাটক দেখেছি। এটা আমার মনে ধরেছে, নতুন চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে।
– কি চিন্তা, বলেনতো?
– যা কিছু আছে তা বিক্রয় করে , হাওলাত-বরাত করে টাকা জমিয়ে ছোট ছেলেটাকে যদি সৌদি আরবে পাঠানো যায়, তাহলে আর দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আর ছোটটা একটু চালাকচতুর, খুবই হিসাবি। তার আশা-সে নিশ্চয়ই তার অন্য ভাই-বোনদের টানবে।
ফজর আলী আরও যোগ করলো। -আমার স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও ছেলেদের বললাম। গরীবের ঘোড়া রোগ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে স্ত্রী ও ছেলেরা উড়িয়ে দিল। জন্মই হয়েছে অভিশপ্ত পরিবারে, আজন্ম পাপে। কপাল পাহাড়ের নীচে চাপা পড়ে গেছে। বেহুদা খরচ করে লাভ কি। কতো কথা শুনাইয়া দিল।
কিন্তু ফজর আলী দমিবার পাত্র নহে। চেষ্টা করলে আল্লাহও মুখ তোলে তাকান- সে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করলো। সে কতোজনের উদাহরণ দিল। অবশেষে তাদের মন গললো। শত হলেও বাবা। তার জীবনের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করাও ছেলেদের কর্তব্য। চেষ্টা করলে দোষ কী?
যেমন চিন্তা তেমন কাজ। পুরো পরিবার আকাশের চাঁদ হাতে ধরার মতো বর্জকঠিন প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে নেমে পড়লো। না খেয়ে, না পরে , অন্যের বাড়িতে সকলে মিলে কয়েক মাস কাজ করলো। বেশ কিছু টাকা জমালো। শরৎচন্দ্রের গফুরের আদুরে “মহেশ” ষাঁড়টিও নিয়মিত পরিচর্যায় বেশ মোটাতাজা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও হাত পাতলো। কিছু টাকা আবার কড়া সুদে ঋণ নিলো। এভাবে যক্ষের ধনের মতো সঞ্চিত সম্পদ এবং ধার-কর্জের টাকা দিয়ে ছোট ছেলে রাজাকে পাঠালো সৌদি আরবে।
মরুভূমির প্রখর সূর্য উতপ্ত উনুনকেও হার মানায়। গরমতো নয়, যেন সূর্য খসে পড়েছে মাথার উপরে। রাতে আবার ভারী ঠান্ডা । কি এক অসহনীয় যন্ত্রণা! কিন্তু তাতে কী? শরীরের নাম মহাশয়, যা ইচ্ছা তা-ই সয়। গরীবের আবার শরীর! তুনুতুনু ভাব গোল্লায় যাক। আর জন্মইতো হাড়ভাঙা খাটুনির জন্যে। বিরূপ ও প্রতিকূল পরিবেশ দেশেও যা বিদেশেও তা। এসব থোড় কেয়ার করার ছেলে নয়। আর বাপকা বেটা। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মাটি কামড়ে থাকা ছাড়া গতন্তরও নাই । তাছাড়া, অতিরিক্ত দু’ পয়সা কামানোর নেশাও তাকে পেয়ে বসেছে। অমানুষিক পরিশ্রমের পর ওভারটাইমও চললো সমান গতিতে। যেন যন্ত্র দানব।
এদিকে কঠোর পরিশ্রম ও গভীর কর্মনিষ্ঠা দিয়ে মালিকের হৃদয় জয় করে ফেলেছে রাজা। একবারেই আনকোরা নিরক্ষর। কিন্তু একান্ত বাঁচার তাগিদে সে প্রয়োজনীয় আধা-আধা আরবি ভাষাও রপ্ত করেছে । লাইন-ঘাট করে বছর খানেকের মধ্যে রাজা তার বড় ভাই জলিলকেও নিয়ে গেলো সৌদির একই কোম্পানিতে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরের বছর এক ভাগিনাও উড়াল দিল মরুর দেশে। একে একে আরও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে তারা নিয়ে গেলো। এ যেন মরুভূমিতে একখন্ড স্বদেশভূমি। এভাবে চার বছরের মধ্যেই চিহ্নভিন্ন হয়ে গেল ফজর আলীর কঠিন জমাটবদ্ধ দারিদ্র্যের বেড়াজাল । ভাগ্যদেবী আর লক্ষ্ণী তার পদতলে ভূলুণ্ঠিত হলো। ফজর আলীকে আর ঠেকায় কে? এর মধ্যে ছেলেরা বিদেশে যায়-আসে। একইভাবে যেমন হিসাবি ছেলেরা, তেমনি বাপ-মা। কেননা, কতো ঘামঝরা কষ্টের টাকা।
বেশ আগের থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। ফজর আলীর অজপাড়াগাঁ গাঁয়েও পড়েছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পাশের গভীর খাদযুক্ত কাঁচা রাস্তা হয়েছে পাকা। বাড়িতে এসেছে বিদ্যুৎ। ফজর আলীর কাছে এগুলো যেন স্বপ্ন,অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়!
ফজর আলী গরীব ছিল। কিন্তু মন ছিল আকাশের মতো উদার। ইচ্ছা থাকলেও তখন উপায় ছিল না। আর এখন কেহ বাড়িতে আসলে খালি মুখে যাবে-সে হয় না। মনে মনে ভাবার আগেই আলেয়া ভাবি রকমারি নাস্তা নিয়ে হাজির। সালাম দিল রহিমুদ্দি।
-ভাবি কেমন আছেন?
-ভালো আছি। ভাবিকে নিয়ে আসলে অনেক ভালো হতো, গল্প করতে পারতাম।
-আচ্ছা, একবার নিয়ে আসবো। ফজর আলী ভাই ভাবির রূপের, গুণের কত গল্প করতো আগে। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেন যৌবনের জৌলুশ ফিরে এসেছে। এসএসসি পাস রহিমুদ্দির মতো মীর মোশাররফ হোসেনের “বিষাদ সিন্ধু” অনেকের ঘরে ঘরে। সেখান থেকে অর্থ সম্পর্কিত বিখ্যাত উক্তিটি সে আওড়ায়।” হায়রে পাতকী অর্থ! তুই জগতে সকল অনর্থের মূল। ” কিন্তু এটা সঠিক না। ফজর আলীর ক্ষেত্রে অবশ্যই না।
দশ-বারো বছরে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকার পর ছেলেদেরও বয়স হয়েছে। হাতে অনেক টাকা পয়সাও জমেছে। তাদের চিন্তা আর নয় বিদেশ। দেশেই ব্যবসা-বানিজ্য করে বাকি জীবন চালিয়ে নিবে। ভালো মানুষের সঙ্গে যুক্তি-পরামর্শ করে নিকটস্থ শহরে মনোহারি ব্যবসা শুরু করলো। ফজর আলীকে করলো ম্যানেজার। মাঝে মাঝে দোকানে বসা, নিয়ম অনুযায়ী মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া-এই তার কাজ। আর সঠিক ওজন ও ভালো ব্যবহারকে সম্বল করে কয়েক বছরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেল তাদের ব্যবসা। সংসারের ঘানিটানার কারনে ছেলেদের পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। এখন আর সেই দিন নাই। তাই শহরে ভালো স্কুলে নাতি-নাতনিরা ভর্তি হলো, বেশ মনোরম পরিবেশে বাসা ভাড়া নিল।

আর সারাজীবন গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়ায় শহরের কোলাহল পরিবেশ, কৃত্রিম জীবন ফজর আলী ও তার স্ত্রীর পছন্দ হয় না। মনে হয় বন্দী জীবন। লেখাপড়া না জানার কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যুগের নাতিদের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই বাপ-দাদার স্মৃতি চিহ্নে ফিরে আসলো। জরাজীর্ণ ঘরটি ভেঙে সাই-সাই করে আধুনিক মানের একটা দালান নির্মাণ করে ফেললো। শত বছর ধরে বনবাদাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সেরে ফেলার নির্লজ্জ ঐতিহ্য আর কি ধরে রাখা যায়? বাড়িতে অন্যান্যদের জন্যও তৈরি করে দিল ছোট মসজিদ, পাকা ঘাটলা আর টয়লেট ।
সপ্তাহান্তে ছেলেরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে। গ্রামীণ সবুজ-শ্যামল গাছপালা, পাখির কুজন, খোলামেলা স্থান তাদের হৃদয়ে দোলা দেয়, সৃষ্টি করে অফুরন্ত আমেজ। আবার পাড়াপড়শি, আত্মীয় স্বজন মিলে সৃষ্টি হয়েছে এক মিলনমেলা। এদের মধ্যমনি আলেয়া-ফজর আলী জুটি মনে হয় পূর্ণ অবসরে, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে বসে খাচ্ছে।
ফজর আলীর পরিচিত ও যাপিত জীবন সম্পর্কে সবকিছু ওয়াকিবহাল রহিমুদ্দি। তারপরও কাছের মানুষকে পেয়ে একনাগাড়ে আশৈশব হতে বর্তমান উত্থান পর্যন্ত জীবনেতিহাস বর্ণনা করে ফজর আলীর সে কি আপ্ত তৃপ্তি, চোখ-মুখে রাজ্যের উজ্জ্বল ঝলক। রহিমুদ্দিও শুনে প্রীত হয়ে আরও বললো,
-ভাই, আপনার দেখাদেখি গ্রামের অনেক অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষিত মানুষ মধ্য প্রাচ্য, মালয়েশিয়া, জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় চলে গেছে। কেহ চাকরি করে, কেহ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। আবার গ্রামের অনেক বেকার ছেলে-মেয়ে শহরে গার্মেন্টস্সহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছে। অনেকে ভালো ব্যবসা করছে। গত বার-চৌদ্দ বছরে দেশের যে কী অত্যাশ্চর্য উন্নতি হয়েছে তা ভাবাই যায় না। নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। এ কী পরিবর্তন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে কী আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ আছে তা বুঝতেই পারছি না। কী তেলেসমাতি কান্ড! আগে একবেলা কোন রকমে খেয়ে পরে থাকতো গ্রামের মানুষ। আর এখন সেই মানুষের চেহারায় রৌশনায় ঝলমল করছে। আমরা সব সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতার জন্য দোয়া করি। জাতির পিতার প্রতি আজন্ম পরম শ্রদ্ধা আর ভক্তি ফজর আলীর। তাকে কি থামানো যায়?
– হায়রে! এমন স্বপ্নের সোনার বাংলা-ই বঙ্গবন্ধু এদেশকে উপহার দিতে ছিলেন। কিন্তু মীরজাফররা সুযোগ দিল না। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করে বললেন, তিনিই আমাদের গরীবের বন্ধু, আমাদের মনের কথা বুঝেন, জানেন। তাঁর জন্য আজীবন প্রাণভরে দোয়া করে যাবো।
সামনে ঈদ। ফজর আলীর নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবীর পণ করেছে গ্রামীণ পরিমণ্ডলে ঈদ করবে। আগেই দাদার বাড়িতে হাযির। ভিতর থেকে এসে দাদার কাছে বসে পড়লো।মনোযোগ সহকারে দুই পড়শির কথা শুনতে লাগলো। রহিমুদ্দী এতক্ষণ পর্যন্ত অনেক কথা বলা এবং শুনার পরও আসল কথা বলার সুযোগ পায়নি।
– ফজর আলী ভাই, অনেক আগে আমাদের অনেকেরই কোরবানি দেয়ার ক্ষমতাই ছিল না। তীর্থের কাকের মতো বড়লোকদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই দিন আর নাই। তবে,অনেক দিন ধরে মহামারী করোনার কারনে গ্রামের কোন কোন মানুষের এবার কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য নাই। এদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। স্বাধীনচেতা এবং মানবিক চেতনাসম্পন্ন নাতি আবীর তাৎক্ষনিক বলে উঠলো। কয়েকদিন গ্রামে ঘুরে দেখেছি। কারো কারো অবস্থা মোটেই ভালো না। চোখ দেখেই বুঝা যায় তাদের অবস্থা। তার দরাজ কন্ঠ। কবিতা আবৃত্তিতে বরাবরই সে অদ্বিতীয়। সাথে সাথে তারাপদ রায়ের বিখ্যাত “দারিদ্র রেখা” কবিতাটি আবৃত্তি করতে লাগলো।
“আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম,খুবই
গরীব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারনের কাপড়
ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন
ছিল না।
বছরের পর বছর আধাপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায়
শুয়ে,
কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা। ”

নিরক্ষর হলেও শিক্ষিত সমাজে এখন ফজর আলীর বসবাস। কবিতার অর্থ বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। এ যেন তাকে নিয়েই কবিতাটি লেখা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অশ্রুসজল নেত্রে নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো- আর কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিস না। ক্ষুধার জ্বালা তোরা বুঝবি না রে। আবীর বলে উঠলো,
– আমরা বড় গরু কোরবানি দিব না। ছোট দেখে দুইটা গরু কিনবো। একটা আমরা সকলে দিব, একটা গরীব এলাকাবাসীর জন্যে। রহিম দাদা, আপনি গরীব মানুষের তালিকা করুন, আমরা ঘরে ঘরে গোশতো পৌঁছে দিব। দুই বৃদ্ধের আনন্দাশ্রু দেখে সেও পুলকিত হলো।

– আচ্ছা, ঈদের পরের দিন স্কুলের মাঠে ছোট কালের হাডুডু খেলার আয়োজন করা যায়। আর সেই কালের অপরাজেয় ফজর আলী ভাই হবেন রেফারি। কিছু পুরষ্কার দেয়া যায়। অনেক অনেক আনন্দ হবে। কি বলেন ফজর আলী ভাই?
ছোট কালের সেই ডানপিটে স্বভাবের কথা মনে পড়ে যায় ফজর আলীর। -আহারে! খুবই ভালো প্রস্তাব। কি বলো, নাতি? ডিজিটাল যুগের সন্তান আবীর। সে যোগ দিল- হ্যা, হতে পারে। তবে, পরের দিন আমরা ইয়াংরা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলবো।
এভাবে ঈদের আমেজে তিনদিন প্রানবন্ত হয়ে উঠেছিল ফজর আলীর সেই ছোট্ট কালের অজপাড়াগাঁয়ের সোনাপুরে। সামান্য কিছু করতে পেরেছে এতেই সে ধন্য।

শেয়ার করুন

Leave a Reply