বহুল আলোচিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাস নিলো ভাড়া বাড়িতে

* অনলাইন ক্লাস দিয়ে যাত্রা শুরু
* মৌজার রেট বৃদ্ধিতে বিতর্কিত স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতিও ভেতরে ভেতরে
ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :
অবশেষে বহুল আলোচিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস দৃশ্যমান হয়েছে। এ যেন রমজান মাসের ঈদের বাঁকা চাঁদটির মতো। কোথায় করা হচ্ছে তা গত কয়েক মাস ধরে কেউ না জানতে পারলেও দু’ সপ্তাহ আগে এর সাইনবোর্ড সাঁটানোয় অনেকেই জানতে পারছে। ২০২০ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া চাঁদপুর ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ৪ বছর পর। অস্থায়ী এ ক্যাম্পাসের ঠিকানা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারনে কাউকে এ তথ্য বলতে নারাজ ছিলো। অবশেষে দেখা গেলো, জেলা শহর থেকে দূরে বাবুরহাট ওয়াপদা গেট এলাকায় চাঁদপুর – কুমিল্লা সড়কপাশে একটি বাড়ির ৬ তলা ভবনের ৫ তলা পর্যন্ত এর অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ভাড়া নেয়ে হয়েছে। এটি চাঁপুর পৌরসভার ১৩ নাম্বার ওয়ার্ড স্থানীয় খুলিশাডুলিতে পড়েছে। ভবনটির একতলায় এবং সামনে একেবারে সড়কের ফুটপাতে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন, গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই প্রতিমাসে ৬০ হাজার টাকা কার্যকর করে তা পরিশোধ করা হচ্ছে প্রতি মাসেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বাড়িতে গত ৫ মাসের মধ্যে কোন শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টাফ কেউই ঢুকতে পারেননি আনুষ্ঠানিকভাবে। মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেলো, শিরোতাজ ম্যানসন নামে ঐ ভবনের একতলার সামনে ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছে। আস্তরন এবং টাইলস বসানো হচ্ছে। উপরে নীচে রুমগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দামি আসবাবপত্রগুলো স্তুপ দিয়ে রাখা হয়েছে। এসব আসবাবপত্র এবং ল্যাবটরির জন্য কেনা যন্ত্রাংশই বেশি। ভবনটিতে এখনো কোন লিফট আনাও হয়নি এবং সংযোগও দেয়া হয়নি। আরিফ নামে বাড়ি ওয়ালার এক আত্মীয় বল্লো – ভাই এখন ফিনিসং এর কাজ চলছে। গতাকাল ভিসি স্যার আইসা ঘুইরা দেইখা গেছেন। তয় হেগো একজন লোক আছে। একটু সামনে যেতেই ষাটোর্ধ একজন, নাম রমজান আলী। পরিচয় দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। দু’ দিন আগে এসেছেন। কাজ তদারকি করছেন।


জানালেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচে ৩ টি বিভাগের শিক্ষারথী ভর্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। এদিকে গত দু’ মাস ধরে শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। আবেদনকারী ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯০ জন ভর্তি হয়ে আছে তিন বিভাগে, জানালেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. নাছিম আখতার। মুঠৌফোনে তার সাথে কথা হলে তিনি আরো জানান, ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। আমাদের নতুন শিক্ষকরা ২ টা বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। এতোবড় একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটাই হলো অনলাইন ক্লাস দিয়ে, এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, আপনারা তো জানেনই, এ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভ‚মি অধিগ্রহণ নিয়ে দেখা দেয় নানা জটিলতা। আমি নিয়োগ পেলাম ২ বছর ২ মাস হলো। এ অবস্থায় গত ২ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাস হলো না। জেলা প্রশাসন প্রস্তাবিত জায়গায় মূল্য নির্ধারণ ঠিক করে দিলেও উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গড়তে কালক্ষেপন হচ্ছিলো। এদিকে বিশ্ব বিদ্যালয় মন্জুরি কমিশন আমাদের বল্লো- অস্থায়ী ক্যাম্পাস তথা বাড়ি ভাড়া করে বিশ্বিবদ্যালয়ের পাঠদানসহ যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতে। এর পর থেকেই বাড়িভাড়া নেয়া হয় এটি। এর চেয়ে ভালো বাড়ি আমরা পাচ্ছিলাম না আপাততঃ । এরজন্য বিজ্ঞাপনও দিয়েছি। তিনি বলেন, বাড়ি ওয়ালা লোন নিয়ে এ বাড়িটা করছে। প্রায় ১ কোটি টাকা লোন পেতে তার বিলম্ব হচ্ছিলো। এখন পেয়ে গেছেন এবং আমরা ঈদের পরে অর্থাৎ মে মাসে বা তার আগেই একাডেমিকসহ সকল কার্যক্রম চালিয়ে নিতে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
এর আগে ২০২১ সাল থেকে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚মি অধিগ্রহণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা করে মেঘনা নদী তীরবর্তী চাঁদপুর সদর উপজেলার ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের বালুখেকো ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ প্রভাবশালী একটি চক্র। তবে সাবেক জেলা প্রশাসক ও প্রশাসনের তৎপরতার কারণে এবং উচ্চ আদালতের রায়ে সেই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। এরপর অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য বাড়ি ভাড়া চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে বিতর্কিত স্থানের পাশে অনেক সুকৌশলে বিতর্কিত চেয়ারম্যান সেলিম খানের স্ত্রীর নামে থাকা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টি জানাজানি হলে সেখান থেকে সরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ কয়েক দিন আগে চাঁদপুর শহরের একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু ওই বাড়ির অবস্থান কোথায়, কার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হলো- এসব বিষয়ে তখন কোনো তথ্য প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য চাঁদপুর শহরেই বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে এবং আমরা যেদিন সেখানে চেয়ার-টেবিল ঢোকাব ওই বাড়িতে, সেদিন অবশ্যই জানতে পারবেন এবং দেখতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০টি আসন করে মোট ৯০টি আসন রয়েছে।
এদিকে, একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেলো, ল²ীপুর ইউনিয়নের সেই বিতর্কিত ৬২ একর জায়গায় চাঁদপুর ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নেয়ার পায়তারা চলছে। ২০১৭ -১৮ সালের ঐ এলাকার মৌজার রেট অনুযায়ী ভ‚মির দাম জেলা প্রশাসন নির্ধারণ করে দেন ১৯৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু সেলিম খান আদায় করতে চেয়েছিলো ৫৬০ কোটি টাকা। কিন্তু তৎকালীন জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ রাষ্ট্রীয় এতোবড় ক্ষতি না চেয়ে মৌজা রেট অনুযায়ী নির্ধারিত দামেই অনড় থাকেন। পরে জমির মালিক সেলিম খান গংরা আদালতে এর বিরুদ্ধে রিট করলে উচ্চ আদালত জেলা প্রশাসকের নির্ধারিত মূল্যকেই প্রাধান্য দেন এবং এই রিট ও কালক্ষেপণ এবং নকল দলিলাদি উপস্থাপন করায় সেলিম খান ও তার ২ সহযোগীর ১ কোটি টাকা জরিমানা করে। এছাড়া দুদকও চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করলে তার এই সম্পত্তিসহ বহু সম্পত্তিতে অসংগতি ও অবৈধ সম্পদের উপর মামলা দায়ের করে। তার সকল সম্পত্তির উপর ক্রোক পরোয়ানা জারি করে। ৩০ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। এদিকে দুদকের মামলায় গ্রেফতার হয় চেয়ারম্যান সেলিম, জেলে যাওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ থেকে তাকে আজীবনের জন্য বহিস্কার করা হয়। সে ছিলো ল²ীপুর মডেল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনমাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেলেও আদালত তার চাঁদপুর ও চাঁদপুরের বাইরে ঢাকা, নারায়নগন্জসহ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দুদকের আবেদনে ক্রোক পরোয়ানা জারি করে। যা এখনো বলবদ রয়েছে বলে জানালেন সদর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার। এই হিসাবে সে তার কোন সম্পত্তিই পরবর্তী আদালত বা দুদকের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বিক্রয় করতে পারবে না।
এদিকে, চলতি বছর ঐ এলাকার জমিসহ সারা দেশে জমির দাম বাড়ানো হয়েছে একরকম অস্বাভাবিকভাবে। যা ২০১৭- ১৮ সালের মৌজার রেটের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। আর এই সুযোগককে কাজে লাগিয়ে আবারও সেলিম গংরা সেই বিতর্কিত স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থায়ীভাবে স্থাপনে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞ মহল বলছেন, যদি কেউ করে তাহলে যে মূল্যে আগে নির্ধারণ করে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান ছিলো, তা দিয়েই করতে হবে। তাছাড়া আগের প্রক্রিয়া জেলা প্রশাসন গেজেট আকারে বাতিলও ঘোষনা করেননি। আর এই এখানের দলিলগুলোর অনেকগুলোই ভুয়া।
এদিকে সরকার দল তথা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্পাদকসহ একটা বিশাল অংশ এবং চাঁদপুরের সাধারণ মানুষও ঐ স্থানে এটির ক্যাম্পাস হোক – তা চায় না। কারণ, এর মাত্র ৪/৫ শ গজ দূরেই মেঘনা নদী। যে কোন মুহুর্তে এটি নদীগর্ভে তলিয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অত্যন্ত সুকৌশলে এটিকে নদী থেকে ৩ কিলো দূরে দেখানো হয়েছে। গতবছর পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীও জায়গাটি দেখতে এলে তাঁকেও বলা হয় নদী অনেক দূর। পরে তিনি নিজেই তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁর চোখে ধরা পড়ে মাত্র কয়েক শ গজ!
সর্বদা দাবিই ছিলো : এতো বড় একটা স্থাপনা নদীর এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় না হয়ে চাঁদপুর- কুমিল্লা সড়কের আশেপাশে, বাবুরহাট – মতলব সড়কে অথবা চাঁদপুর- ফরিদগঞ্জ সড়কের কোন একটা চমৎকার ও টেকসই স্থানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি হোক । এমনকি যদি সেটি কোন মন্ত্রী এমপির বাড়ির আশেপাশেই হোক, তাও সবাই সেটিকে সাধুবাদ জানাবে।

শেয়ার করুন