সংস্কারের অভাব ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি বিলীনের পথে

মানিক ভৌমিক :
কচুয়া থানার পশ্চিম দিকে বাউন্ডারী দেয়াল ঘেঁষে থানা পুকুরের উত্তর পারে কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি অবস্থিত। কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি কচুয়া বাজারের একটি অন্যতম পুরাতন স্থাপনা। সংস্কারের অভাবে ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে লাইব্রেরিটি বর্তমানে বিলীন হওয়ার সম্মুখীন।
স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৯ সালে তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ মোঃ জবানউল্লাহ, সাব রেজিস্ট্রার মোঃ আলী ও সুশীল সমাজের উদ্যেগে প্রথমে ‘কচুয়া পাবলিক ক্লাব’ নামে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটিকে “কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি” নাম দিয়ে লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয়।


১৯৮৭ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ক ম মাহবুবুল আলম ‘কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি’র সভাপতি ও বাবু সনতোষ চন্দ্র সেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে লাইব্রেরির কার্যক্রম বেগবান করেন। সেসময় লাইব্রেরিটি পরিচালনা ও দেখভাল করতেন বাবু সন্তোষ চন্দ্র সেন। তিনি কচুয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (পরবর্তীতে সরকারিকরণ হয়) শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি এই লাইব্রেরিটি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন। তখন স্কুল শেষে ছাত্রছাত্রীদের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে দেখা যেতো। পরবর্তীতে অব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের অভাবে ৯০’র দশকের প্রথম থেকেই পাবলিক লাইব্রেরিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। লাইব্রেরির টিনের চালা ফুটো হয়ে যায়, বৃষ্টির পানিতে বই পত্র নষ্ট হয়, পুরাতন দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে, মেঝেতে লতা জাতীয় গাছ গজিয়ে উঠে। পাবলিক লাইব্রেরিটি সাপ ও ইঁদুরের আস্তানায় পরিনত হয়।
লাইব্রেরীর পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেঁষে প্রায় ৬ ফুট প্রশস্থ ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের সরকারী রাস্তা পুকুর পর্যন্ত গিয়েছে। এই রাস্তার শেষ অর্ধেক একজন দখলদার টিন দিয়ে বেড়া দিয়ে ঘর তুলে নিয়েছিল এবং পরিত্যক্ত জায়গা হওয়ায় লাইব্রেরির পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেiয়াল ঘেঁষে উন্মুক্ত প্রস্রাবখানা গড়ে ওঠে। অবস্থা এমন হয় যে প্রস্রাবের দূর্গন্ধে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে কেউ যেতো না, গেলে নাকে হাত চেপে দ্রুত লাইব্রেরি’র স্থান পার হতো।
পরিত্যক্ত লাইব্রেরীটি ২০০৫ সালে “শিকড়” নামে সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নজরে আসে। কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি’র সভাপতি তৎকালীন ইউএনও মোঃ কামরুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক বাবু সনতোষ চন্দ্র সেনের সাথে কথা বলে শিকড় সংগঠনের সদস্যরা পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে পড়ে। কাজটি মোটেই সহজ ছিলো না।
বাজারের এই অংশে কোনো পাবলিক টয়লেট না থাকায় মানুষকে কিছুতেই প্রস্রাব করা থেকে বিরত করা যাচ্ছিলো না। লাইব্রেরী’র সামনে একটি চাপকল থাকায় বাজারের মানুষ এখান থেকে পানি নিতো এবং একই জায়গায় প্রস্রাবের কাজও সেরে ফেলতো। সংগঠনের ছেলেরা চাপকলটি সরানোর ব্যবস্থা করে। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বাধা দেয়। তাদের জন্য পৌরসভার সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করা হয়। দরজা বরাবর একটি পুরাতন বিদ্যুতের পিলার ছিলো। পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির সহায়তায় পিলারটি সরানো হয়। লাইব্রেরি’র পশ্চিম পাশের রাস্তার দখলদারকে উচ্ছেদ করে পুকুরে যাওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়।
“শিকড়” সংগঠনের সদস্য খোরশেদ আলম, মফিজুল ইসলাম, নওশের আলম, বিল্লাল হোসেন, সেফায়েত উল্যাহ, ডি.এম. সালাউদ্দীন, শফিউল্লাহ, মহসিন, ইলিয়াস, শাহজাহান, জহির, মাসুদ রানা, ইউসুফ, আমি ও অন্যান্য বন্ধুদের সহযোগিতায় লাইব্রেরি সংস্কারে ফান্ড গঠনের উদ্যেগ নেয়া হয়। ইউএনও মোঃ কামরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘর মেরামত, সিলিং তৈরি, আলমিরা ও অন্যান্য ফার্নিসার ক্রয় করা হয়।
চমৎকার ও পাঠোপযোগী পরিবেশ তৈরি করে নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রদীপ সরকারকে লাইব্রেরিয়ান হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২০০৫ সালে কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি পুনরায় নিয়মিত চালু করা হয় এবং কমিটি পূনর্ঘটন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান পদাধিকার বলে কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি’র সভাপতি এবং সুশীল সমাজের উপস্থিতিতে আমাকে (মানিক ভৌমিক) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
সুন্দর পড়ার পরিবেশে লাইব্ররি’র কর্মকান্ড সঠিকভাবেই চলছিলো। করইশ গ্রামের কৃতি সন্তান মোঃ ইয়াকুব হোসেনের (বর্তমানে পরিচালক, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি) সৌজন্যে একটি দৈনিক পত্রিকা, শিকড় সংগঠনের সৌজন্যে পত্রিকা ও সাপ্তাহিকী রাখা হতো। প্রদীপ সরকার নিয়মিতভাবে প্রতিদিন বিকালে লাইব্রেরি চালু রাখতেন।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। ২০০৮ এর এপ্রিলে কালবৈশাখী ঝড়ে লাইব্রেরি’র পূর্ব-দক্ষিণ কোনে পুকুর পারের বিশাল একটি চামল গাছ উপড়ে আড়াআড়ি ভাবে লাইব্রেরি ঘরের উপর পরে। ঘরটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। বই ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে পড়ে। শিকড় সংগঠনের সদস্যরা ধ্বংসস্তুপ থেকে কিছু আসবাবপত্র ও বই উদ্ধার করে। তৎকালীন পৌরমেয়র হুমায়ুন কবির পৌরসভায় একটি কক্ষ দিলে সেখানে বই ও আসবাবপত্র রাখা হয় যা এখনোবধি রয়েছে।
লাইব্রেরিটি সংস্কারের জন্য সকল আবেদন-নিবেদন ব্যর্থ হয়েছে। মাননীয় সাংসদ ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাবস্থায় (২০১২-১৩ খ্রিঃ) পাবলিক লাইব্রেরি’র দূরাবস্থার কথা অনেকবার বলেছি। তিনি পাবলিক লাইব্রেরি বড় পরিসরে কোয়া সেন্টারে তৈরি করার আশ্বাস দেন। বর্তমানে নতুন মিলনায়তনটি যেখানে তৈরি হচ্ছে সেখানেই পাবলিক লাইব্রেরী হওয়ার কথা ছিলো।
এদিকে ভগ্ন লাইব্রেরি’র স্থানটি দখলে নেওয়ার পায়তারা করছে বিভিন্ন মহল। লাইব্ররি’র দরজা বরাবর কলের স্থানটিতে ঘর তুলে ফেলেছে দখলদাররা। কয়েকটি নামধারী সংগঠন লাইব্রেরিটি দখলের চেষ্টাও করেছিলো। মেয়র নাজমুল আলমের বাধায় তারা সফল হতে পারেনি।
লাইব্রেরিটি পুনঃ সংস্কারে ও দখলমুক্ত করতে সকলের সহযোগিতা একান্ত দরকার। একটি ১ম শ্রেনির পৌরসভায় পাবলিক লাইব্রেরি না থাকা দুঃখজনক। বর্তমান মেয়র নাজমুল আলম স্বপন সাহেবের সাথে পাবলিক লাইব্রেরীর বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন এবং তাৎক্ষণিক পৌরসভার সচিব মহোদয়কে ডেকে খুব শীঘ্রই লাইব্রেরি চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছেন। মেয়র মহোদয়, প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন ও সুহৃদগণের সহযোগীতায় কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি অচিরেই চালু হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : মানিক ভৌমিক, সভাপতি, কচুয়া প্রেসক্লাব ও সাধারণ সম্পাদক, কচুয়া পাবলিক লাইব্রেরি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply