সাংবাদিক নেতা ইকরাম চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ইকরাম চৌধুরী ১৯৬৬ সালের ১৫ অক্টোবর ফরিদগঞ্জ উপজেলাধীন ২নং বালিথুবা ইউনিয়নের সোসাইরচর চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, চাঁদপুর মহকুমা শিক্ষা শিক্ষা অফিসার মরহুম দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, যিনি ছিলেন ষোলঘর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও ছোট সুন্দর এ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। মাতা মরহুমা জাহানারা দেলোয়ার ছিলেন একজন সুগৃহিণী।
ইকরাম চৌধুরীর অতি শৈশবকাল গ্রামের বাড়িতে কাটলেও ১৯৬৯ সাল থেকে চাঁদপুর শহরের নাজিরপাড়াতেই তাঁর বেড়ে ওঠা ও প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি ভর্তি হন হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৮১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। এ কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন কুমিল্লাস্থ লিয়াকত পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। এখান থেকে ১৯৮৭ সালে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা পাস করে তিনি বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)-এ টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিলো লক্ষ্মীপুর, ফেণী, কক্সবাজার ও চাঁদপুর। এসএসসি পাসের পর পড়ালেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে নেশা হিসেবে গ্রহণের পরিণতিতে ১৯৯৯ সালের শুরুতে তিনি টেকনিক্যাল অফিসারের চাকুরিতে ইস্তফা দেন এবং দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
সাংবাদিকতায় ইকরাম চৌধুরীর গুরু হচ্ছেন দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন। কুমিল্লায় লিয়াকত পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়ার সময় চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী গ্রামের হেলাল উদ্দিনকে তিনি ওই ইন্সটিটিউটের সিনিয়র শিক্ষার্থী হিসেবে পান, যিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বস্তুত হেলাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও প্রণোদনায় ইকরাম চৌধুরী সাংবাদিকতায় আসেন। স্বল্প সময়ের জন্যে তিনি দৈনিক সংগ্রাম এবং তারপর দৈনিক ইনকিলাবে চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি সাপ্তাহিক রূপসী চাঁদপুরে যথাক্রমে বার্তা সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি দৈনিক চাঁদপুর দর্পণের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন, গত ২১ বছরে যেটির ধারাবাহিক প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে। তিনি দৈনিক যুগান্তরের জন্মলগ্ন থেকে চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। একই সাথে চ্যানেল আইতে প্রথমে জেলা প্রতিনিধি এবং পরবর্তীতে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জাগো নিউজে’ও জেলা প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন।
নব্বইর দশকে চাঁদপুর প্রেসক্লাবে সদস্য হিসেবে যোগদানের পর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন শেষে তিনি যুগ্ম সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। ২০০২ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। সভাপতি পদে চাঁদপুর কণ্ঠ সম্পাদক অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশারের সাথে একটানা তিন মেয়াদে দক্ষতা ও সুনামের সাথে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচন নিয়ে জটিলতায় দ্বিধা বিভক্তি সৃষ্টি হলে তিনি ২০০৯ সালে চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতের সাথে ঐক্য প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সেমতে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট সমঝোতা কমিটি গঠিত হয়। সে কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে তিনি ২০০৮ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি পান এবং ২০১১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেন। সর্বশেষ চলতি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি তিনি তৃতীয় মেয়াদে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর সাথে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন চাঁদপুর কণ্ঠের বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহছান উল্লাহ।
জনাব ইকরাম চৌধুরী চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক (২০০২-২০০৭) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রেসক্লাবের বিদ্যমান টিনশেড ভবনের পরিবর্তে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন, সভাপতি অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশারের সহযোগিতায় যে ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু অর্থাভাবে একতলার অনধিক নির্মাণ কাজ অসম্ভব হয়ে পড়লে ২০১১ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালনকালে ইকরাম চৌধুরী ভবনটির ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে জেলা পরিষদে প্রকল্প দাখিল করেন। যে প্রকল্পের অনুকূলে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপির বদান্যতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯০ লক্ষ টাকার অনুদান প্রদান করেন, যাতে ভবনটির তিন তলার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এর ফলে ভবনটির ১ম তলায় আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার ও দ্বিতীয় তলায় চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু হয়, যেগুলো প্রেসক্লাবের শক্ত আর্থিক ভিত্তি নির্মাণ করে।
ইকরাম চৌধুরী প্রেসক্লাবের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক সংগঠনে উপদেষ্টা এবং রেডক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চাঁদপুরে বসবাসকারী ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফরিদগঞ্জ ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি শক্তিশালী রূপ প্রদান করেন। এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ও স্থায়ী কার্যালয় স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
ইকরাম চৌধুরী শুধু সাংবাদিকতাই করেননি, অনেককে এনেছেন সাংবাদিকতায়। তাঁর কাছ থেকে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি নিয়ে জেলা, উপজেলা ও জাতীয় পর্যায়ে অনেকেই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। জেলাব্যাপী তাঁর সংবাদের রয়েছে অনেক ভক্ত পাঠক ও শ্রোতা। এদের সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে গতকাল শনিবার ভোর ৪টায় তিনি কিডনী সংক্রান্ত জটিলতায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।
তিনি দেড় দশকেরও অধিক সময় ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। বছর দুয়েক আগে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাশেষে তাঁর হার্টে এনজিওপ্লাস্টি (রিং পরানো) হয়। তারপর তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত হলে এক পর্যায়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে তার দুটি কিডনীই অকেজো হয়ে যায়। মার্চ মাস থেকে তিনি প্রেসক্লাবে সরাসরি এসে সভাপতির দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন। চাঁদপুর প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ ভারতে নিয়ে কিডনী সংযোজনের নিমিত্তে তাঁর চিকিৎসার্থে তহবিল সংগ্রহে সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ জালাল চৌধুরীকে আহ্বায়ক, সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারীকে সদস্য সচিব এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহকে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে একটি উপ-কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ২১ লক্ষাধিক টাকাও সংগ্রহ করে। এছাড়া চ্যানেল আই পরিবার সাড়ে ১১ লক্ষ টাকা, পিআইবির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানপুষ্ট সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট ২ লক্ষ টাকা, ফরিদগঞ্জ ফাউন্ডেশন ১ লক্ষ টাকা, সহপাঠীবৃন্দ ২ লক্ষ টাকা, জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা বিভাগ ১ লক্ষ টাকা প্রদান করে। এতো টাকার সংস্থার হলেও বৈশি^ক মহামারী করোনার কারণে তাঁকে ভারত নেয়া যাচ্ছিলো না, আর কিডনী দাতা জোগাড় হলেও কিডনী সংযোজন সম্ভব হচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় জুলাই মাসে ঢাকায় তাঁর ডায়ালাইসিস শুরু করা হয়। নবম দফা ডায়ালাইসিস শেষে তিনি চাঁদপুর আসলে শ^াসকষ্টজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় ওইদিন ৫ আগস্ট ২০২০ বুধবার রাতে তাঁকে চাঁদপুর শহরের ষোলঘরস্থ বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ঐ রাতেই ঢাকার ধানমন্ডীস্থ কিডনী এন্ড জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এখানেই তিনি শনিবার ভোর রাত ৪টায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে ইকরাম চৌধুরীর বয়স হয়েছিলো ৫৩ বছর ৯মাস ২৩ দিন। তিনি স্ত্রী এবং ১ ছেলে ও ১ মেয়ে, ৫ ভাই ও ৩ বোনসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। তাঁর ছেলে আবরার হোসেন চৌধুরী (প্রিয়াম) নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পাসকৃত কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার ও মেয়ে ইসমত আরা ইয়ানা চাঁদপুর সরকারি কলেজের স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছেলে ও মেয়ে দুজনই বিবাহিত। স্ত্রী আসমা ইকরাম একজন সুগৃহিণী।
ইকরাম চৌধুরী তাঁর দুভাইকেও সাংবাদিকতায় আনেন। তৃতীয় ভাই মুনির চৌধুরী দৈনিক দিনকালের জেলা প্রতিনিধি ও চাঁদপুর প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক এবং কনিষ্ঠ ভাই শরীফ চৌধুরী চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার ও দৈনিক নয়াদিগন্তের জেলা প্রতিনিধি। তাঁর বড় ভাই এবিএম সাহিদ হোসেন চৌধুরী প্রিন্টিং ব্যবসায়ী, মেঝো ভাই আকবর হোসেন চৌধুরী ইমপ্রেস গ্রুপের কমার্শিয়াল ম্যানেজার, চতুর্থ ভাই ডাঃ ইকবাল হোসেন চৌধুরী জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারীর অধ্যাপক। ইকরাম চৌধুরী জন্মক্রমে ভাই-বোনদের মধ্যে নবম এবং ভাইদের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন। (জীবন বৃত্তান্ত সম্পাদনায় কাজী শাহাদাত)

শেয়ার করুন

Leave a Reply