সাদাসিধে ছাত্রজীবন ও উন্নতচিন্তা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন ::
প্রতিটি শিক্ষার্থীরই আদর্শ হওয়া উচিত সাদাসিধে জীবন যাপন করা। আমাদের শিক্ষায় বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ বা আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। আমাদের সময়ে দশম শ্রেণিতে রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্য শিক্ষা’ পুস্তকে পড়েছি-
অট্টালিকা নাহি মোর, নাহি দাসদাসী
আমি নহি কভু, সে সুখ প্রয়াসী
আমি থাকি ছোট ঘরে বড় মন লয়ে
নিজের সুখের অন্ন, খাই সুখী হয়ে
শ্রম দিয়া কর সবে, বিদ্যা উপার্জন
সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন।
এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে
যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে।

আর্থিক সঙ্গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই একজন শিক্ষার্থীর গায়ের জামা কেনা উচিত অন্যদিকে অভিভাবকের আর্থিক সঙ্গতির সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানো উচিত। আমাদের দোষ হলো-আমরা যা না তা দেখাতে চেষ্টা করি। এই ঠাঁট বজায় রাখতে গিয়েই আজ সমাজের লোকদের এমন অধ:পতন। অনেক অভিভাবক সন্তান লালন ও শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের অযুহাত দেখিয়ে কর্মস্থলে ঘুষ খাওয়া, অন্যের টাকা ছিনতাই করা, দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে চলাফেরা করা, নানারকম ফন্দি-ফিকির করে বেশি টাকা উপার্জন করার চেষ্টা করেন। আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাই-
“ছেঁড়া ধুতি আপনার,
ঢের বেশি দাম তার
ধার করা সাটিনের চেয়ে”

আমরা বিদেশী বস্ত্রে অঙ্গকে শোভিত করে বুক ফুলিয়ে চলার চেষ্টা করি। হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় নকল করার সুযোগ নেয়া অথবা প্রশ্নপত্র ফাঁস বা কোচিং সেন্টারে বিশেষ পাঠদানের চুক্তিনামা করে অধ্যয়ন করা বা একজনের পরীক্ষা অন্যজনকে দিয়ে দেয়া ইত্যাদি কর্মে সম্পৃক্ত, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? বিদ্যা এখন বিক্রি হচ্ছে। ক্রয়কৃত বিদ্যা বর্তমানে অচল হিসেবে দেখা দিয়েছে । আমি কোনো এক শিক্ষককে বললাম, “আপনারা কেন এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন”। উত্তরে তিনি বললেন, “যুগের হাওয়া, দশচক্রে ভগবানও ভুত হয়।” আমিও একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষকের মুখে এ কথা শুনে অবাক হলাম । কিন্তু ‘সত্য’ যদি মাথা নত করে, ‘অসত্য’ তখন মাথা উঁচু করে দাড়াবেই। অসত্য, ঘুষ, দুর্নীতির দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না বলেই এগুলি এতটা বেড়ে চলছে। খাটি বিদ্যাধন কেহ কেড়েও নিতে পারবে না বরং যত বিলাবে ততই শাণিত হবে। বর্তমানের এই নকল বিদ্যা কেহ এমনিতেই নিতে চায় না। এটা শ্বাশত সত্য, ধনদৌলত নষ্ট হয়, কিন্তু বিদ্যা কখনো নষ্ট হয় না। আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন পন্ডিত আলি হোসেন স্যার তিনি প্রায়ই বলতেন, “সব অন্যায় দূর হয়ে যাবে, যদি মিথ্যা বলা বন্ধ করা যায়।” হাওয়াই চপ্পল পরে স্যার বিদ্যালয়ে আসতেন। ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পলের ফিতা খুলে যেতো অনেক সময়। স্কুলের মাঠে কিংবা লাইব্রেরির সামনে, কখনও ক্লাসে দাঁড়িয়েই তিনি ওটা হাতে নিতেন। ফিতাটা ঠিক করে আবার হাঁটতে শুরু করতেন। এতে তাঁর মর্যাদা একটুও কমেনি, তাঁর পান্ডিত্য ও দায়িত্ববোদের কাছে এসবই ছিল তুচ্ছ। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর ওই চপ্পল জোড়া চেয়ে নিতাম। মানুষ আকৃতির কাউকে কাউকে জড়িয়ে ধরার চেয়ে ওই চপ্পল জোড়া বুকে জড়িয়ে ধরতাম। চপ্পল দিয়ে আরও একটা কাজ করতাম। কিন্তু কাজটি কী-তা আর আমার বলতে ইচ্ছে করছে না সম্মানিত পাঠক আপনারাই বুঝে নিবেন।
লেখক: প্রফেসর ড. মোঃ লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply