সুযোগ পেলেই ইলিশ ধরতে নদীতে নামছে অসাধু জেলেরা

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকারের অপরাধে ১৩ দিনে কয়েকশ’ জেলে আটক
ইব্রাহীম রনি
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ইলিশ শিকার করছেন অসাধু জেলেরা। মা ইলিশ নিয়ে এখন নদীতে চলছে ‘চোর-পুলিশ খেলা’। ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নদীতে নামছেন জেলেরা। এমনকি নদীতে অভিযানকালে টাস্কফোর্সের সদস্যদের উপর চড়াও হচ্ছেন বেপরোয়া জেলেরা। গত ১৩ দিনে নৌপুলিশসহ টাস্কফোর্সের অভিযানে কয়েকশ’ জেলে আটক করা হয়। মা ইলিশ রক্ষায় নদীতে টাস্কফোর্সের তৎপরতা থাকলেও তা যথেষ্ট মনে করছেন না স্থানীয়রা। জেলেদের দাবি, মৌসুমি জেলেরা চুরি করে মাছ ধরছে। আবার অনেকে অভাবে পড়ে নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে মাছ শিকার করতে যাচ্ছে।
চাঁদপুরের জেলে ও জেলা টাস্কফোর্স সূত্রে জানা গেছে, ব্যাপক হারে মা ইলিশ নিধন করা হচ্ছে সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর, হরিণা, কাচিকাটা, লক্ষ্মীপুর, বিষ্ণুপুর, হাইমচরের চরাঞ্চলের নীলকমল, হাইমচর ইউনিয়ন, গাজীপুর এবং মতলব উত্তরের কয়েকটি এলাকায়। এসব মাছ বিক্রির জন্য নদীপাড়ে অস্থায়ী কিছু আড়ত বসেছে। এ আড়তগুলোতেই জল ও স্থলপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে মাছ কিনে নিয়ে স্পিডবোটসহ সুবিধাজনক নৌযানযোগে। চুরি করে শিকার করা এক কেজি সাইজের এক হালি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫শ থেকে তিন হাজার টাকায়।
চাঁদপুর সদরের পুরাণবাজার এলাকার জেলে আকিদুর রহমান, জসিম উদ্দিনসহ কয়েকজন জেলে বলেন, আমাদের কিস্তি আছে। সংসারের খরচ চালাতে হয়। সরকার শুধু ২৫ কেজি করে চাল দেয়। শুধু চাল দিয়েতো আর সংসার চলে না। আমরা কি খালি ভাত খাবো? তাই বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ সময়ে কেউ কেউ নদীতে মাছ শিকার করতে যায়। কোথাও কোথাও নৌপুলিশের সদস্যদের সাথে অসাধু জেলেদের যোগসাজস রয়েছে বলেও জানান কয়েকজন জেলে।
হাইমচরের জেলে রফিক প্রধানীয় বলেন, সরকার মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান দিয়েছে, আমরা তা মেনে চলছি। অভিযানের শুরু থেকেই আমরা জাল-নৌকা উঠিয়ে রেখেছি। তবে আমরা এখনো চাল পাইনি।
আটককৃত কয়েকজন জেলে বলেন, শুধু চাল দিয়েতো সংসার চলে না। তাই পেটের দায়ে আমরা নদীতে নেমেছি। ধরা পড়েছি- এখন জেলে পাঠালো কিছু করার নেই। আমরাতো রাজা-বাদশা না। আমাদের যদি টাকা-পয়সা থাকতো তাহলেতো নদীতে নামতাম না। তাছাড়া এই ২২ দিনে নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায়। অন্য সময় তেমন পাওয়া যায় না।
আরেক জেলে বলেন, আমরা এক কেজি চালও এখনো পাইনি। কেউ কেউ হয়তো পেয়েছে। আমি যখন নদীতে আসি তখন আমার বাড়িতে চাল নেই। আমার ছোট বাচ্চার জন্য দুধ নেয়ার দরকার ছিল। স্ত্রীকে বলেছিলাম- আসার সময় দুধ আর চাল নিয়ে আসবো। কিন্তু নদীতে গিয়ে ধরা পড়েছি।

জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও দাদনদাররা মুল হোতা

মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন স্থানে মাছ শিকার করছেন অসাধু জেলেরা। আর পেছন থেকে তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছেন ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও দাদনদাররা। তাদের প্রত্যক্ষ মদদেই মাছ ধরা থেকে শুরু করে বিক্রি কাজটি হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ওইসব প্রভাবশালীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু কবে নাগাদ ওই তালিকা তৈরি হবে সেটি খোলাসা করেনি নৌপুলিশ।

যা বলছে নৌপুলিশ

চাঁদপুরে মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমে এসে নৌপুলিশের অতিরিক্ত আইজি শফিকুল ইসলাম বলেছেন, বড় বড় কিছু ব্যবসায়ী আছেন, কিছু সমাজপতি আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই দাদন অর্থাৎ জেলেদেরকে টাকা ঋণ দেন। যে সময়ে জেলেরা অভাবে তখন তখন উচ্চ সুদহারে তাদেরকে দাদন দেন। দাদন নেয়ার পর নদীতে যাওয়া তাদের জন্য অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। অর্থাৎ জেলের পেছনে প্রভাবশালী দাদনদার তাকে আশ্বস্ত করছেন, কোন সমস্যা নেই, তুই যা, বাকীটা আমি দেখবো’- এমন অবস্থায় দাদনদারের ভয়ে বা প্রশ্রয়ে হোক জেলেরা নদীতে যাচ্ছে। এই লোকগুলোই মূলত দায়ি। দাদনদারদের অনুরোধ করছি, মা ইলিশ শিকারে আপনারা দাদন ব্যবসা বন্ধ করুন। ইলিশ মাছ শিকারীদের দাদন যারা দেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। জেলেদের পেছনের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার স্থানীয় প্রভাবশালীদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি বলেন, আপনারা যদি সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকতে হবে। ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা খুব সহজ একটি বিষয়। প্রভাবশালী লোকজন, চেয়ারম্যান, মেম্বার, আড়তদার, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যদি চাইলে একজন জেলেও নদীতে নামবে না। এছাড়া নদীর খালের মুখগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এখানে চোর-পুলিশ খেলা হয়। যখন পুলিশ আসে তখন খালে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। আর পুলিশ চলে গেলে নদীতে নেমে পড়ে। এটি যৌক্তিক নয়। এভাবে আপনারা নিজের ক্ষতি করছেন।
জেলেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা যে দাদন নিচ্ছেন তা ব্যাপক হারে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদি দাদন না নিতেন তাহলে এতো চড়া সুদ আপনাকে দিতে হতো না। তাই আমি অনুরোধ করবো, দাদন নিবেন না, দাদন দিবেন না।
তিনি আরও বলেস, একটি মাছকে ডিম পাড়ার সুযোগ দিলে কত লাখ মাছ হবে সেটি বুঝতে হবে। এখন যদি মা ইলিশ ধরেন তাহলে সামনের বছর কি ধরবেন? ইলিশ ধরতে অন্য কেউ এখানের নদীতে আসবে না, আপনারাই ধরবেন। তাই একটু ধৈর্য্য ধরুন।
তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, সরকার কিন্তু কারো কাছে মাথা নত করে না। তাই লুকোচুরি করে সফল হওয়া যাবে না। এখানে নৌপুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে। মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রমকে সফল করতে চাঁদপুরে অতিরিক্ত পুলিশ দেয়া হয়েছে। আমরা চাইনা জেলেরা কারাগারে যাক। এরপরও যদি কেউ নদীতে নামে তাহলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং তার পেছনের লোকদের বিরুদ্ধের আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চাঁদপুর নৌথানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফল করতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। নিষিদ্ধ সময়ে কিছু জেলে নানা কৌশল অবলম্বন করে মাছ শিকার করছে। কোথাও কোথাও অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে মা ইলিশ শিকারের কাজে। তাদেরকে আটক করা হলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আর প্রাপ্ত বয়স্কদের আটকের পর মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হচ্ছে।

জড়িতদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর

স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রজনন মৌসুমের এই তিনটি সপ্তাহ মাছ না ধরলে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এরপর যখন জেলেরা নদীতে নামবে তখন চারপাশে মাছের একটা উৎসব হবে।
তিনি বলেন, জেলেদের পেছনে দাদনদার, আড়তদার, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ নানা ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এর সাথে জড়িত থাকে। যারা জেলেদেরকে নদীতে নামায়, দাদন দেন, যারা এখান থেকে মাছ ধরে সারাদেশে পাচার করে তাদেরকে চিহ্নত করে ধরতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমি প্রশাসনকে বলেছি, ব্যক্তি যেই হোক না কেন দেশের সম্পদ বিনষ্ট করার সঙ্গে যে কেউই জড়িত থাকুক না কেন তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
দীপু মনি বলেন, মা ইলিশ রক্ষার এই কাজটি করার জন্য সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। ইলিশ বাড়লে মৎস্যজীবীরাই লাভবান হবেন।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী বলেন, মা ইলিশ সংক্ষণে গত ১০ দিনের অভিযানে শতাধিক জেলেকে আটক করা হয়েছে। সেই সাথে বিপুল পরিমাণ জাল জব্দ করে তা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। আর জব্দকৃত মা ইলিশ স্থানীয় এতিমখানা ও দুস্থদেও মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কিছু মাছ কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যেই চাঁদপুরের তালিকাভূক্ত জেলেদের চাল সহায়তা দিয়েছে সরকার।

শেয়ার করুন