সেই চেয়ারম্যান সেলিমের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনে দুদকের মামলার অনুমোদন

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপির সেই আলোচিত চেয়ারম্যান বালু খেকো নামে পরিচিত মো. সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে সেলিম খানের বিরুদ্ধে সাড়ে ৩৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়। রোববার দুপুরে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এ তথ্য জানান দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন।
দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
তিনি জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেলিম খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্পদ বিবরণী চায় দুদক। সেলিম খান ৬৬ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব জমা দেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে তার ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন সভায় সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৯ সালে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে চাঁদপুরে অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। সেখানে গৃহহীনদের কাছ থেকে প্রতিটি ঘর বরাদ্দ বাবদ ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়ার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। সে বছরেরই ৩১ অক্টোবর কমিশন সেলিম খানের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেলিম খান ও তার স্ত্রী শাহানারা বেগমের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিয়েছিল দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেলিম খানের আয়কর বিবরণীসহ বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই শেষে তার পারিবারিক ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায় ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রাপ্ত বেতন-ভাতা ও ঋণসহ তার মোট আয় পাওয়া যায় ৬১ লাখ ৭২ হাজার টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেওয়া হয়।
তবে সেলিমের সম্পদের অনুসন্ধান ও তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দুদকের কাছে সেলিমের যে সম্পদের তথ্য রয়েছে, তা প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া নামে-বেনামে তার বেশ কিছু সম্পদের তথ্যও রয়েছে দুদকের কাছে। সেসবের মূল্য এখন পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেনি সংস্থাটি।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল বিকালে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিষয়ে পাওয়া অভিযোগ এবং তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাসের প্রথম দিকে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম পাঠানো হয়েছিল। বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।’
তিনি বলেন, ‘চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে আমরা প্রাথমিকভাবে জেনেছি, জেলা প্রশাসন যখন ওই জমির মূল্য নির্ধারণ করে তখন বিষয়টি ধরা পড়ে। লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জমির বেশি মূল্য দেখিয়ে প্রায় ১৩৯টি দলিল করেছেন। এতে জমির বিক্রি-ক্রয় দেখিয়েছেন, যাতে মৌজামূল্য বাড়িয়ে ২০ গুণ দেখানো হয়। ওই প্রাক্কলনে যাতে বর্ধিত মূল্যটি আসে তার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন বিষয়টি বুঝতে পারায় পরে তিনি আর এটি নিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু দলিল এবং তার প্রসেস তিনি নিয়েছিলেন। তিনি যদি সফল হতেন তাহলে সরকারের ৩৬০ কোটি টাকা গচ্ছা যেত। এ বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এ কাজে তিনি সফল না হলেও এটি একটি জালিয়াতি।’
দুদক সচিব বলেন, ‘চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা থেকে অনুমতি ছাড়াই নির্বিচারে বালু উত্তোলন করেন। কারণ বালু মহল ইজারার একটি বিষয় আছে। এখানে যদি সেরকম কোনও কিছু না থাকে তাহলে তিনি কীভাবে বালু উত্তোলন করছেন, কত দিন ধরে তুলছেন- এ বিষয়গুলো আমাদের এনফোর্সমেন্ট টিম সেখানে গিয়েছিল। তারা জেলা প্রশাসন, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছ থেকে আরও তথ্য নেবে। এরপর যে বিষয়গুলো উঠে আসবে সেগুলো সম্পর্কে আইন মোতাবেক সামনের দিকে অগ্রসর হবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপাতত জমি অধিগ্রহণের সুযোগে দলিল বেচাকেনা করে মূল্য বৃদ্ধি এবং বালু উত্তোলনের বিষয়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম তথ্য পেয়েছে। এ সম্পর্কে আরও যখন অনুসন্ধান হবে তখন এর সঙ্গে আর কারা জড়িত বা কী কী বিষয় সম্পৃক্ত আছে সেগুলো জানা যাবে। যারাই এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের নাম অটোমেটিক্যালি চলে আসবে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শেষ হলে সেটি কমিশনে উপস্থাপন করা হবে। এরপর আইন যে বিষয়টি পারমিট করে সেটি করা হবে।’
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে তৎকালীণ জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণ করা দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।
এ ছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এ ছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।
বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে তথা চাঁদপুরের সম্পদ রক্ষায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ মূল জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা কর্মি ও সাধারন মানুষ । এ বিষয়ে চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছিলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সব দলিল ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে দাম হতো ৫৫৩ কোটি টাকা। আর যে দলিলগুলো উচ্চমূল্যের সেগুলো বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করলে দাম আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধে সেলিম খান ও অন্যরা আদালতে রিট করেন।
কিন্তু সরকারি বিপুল অঙ্কের টাকা রক্ষায় রাষ্ট্রপক্ষের শক্ত অবস্থানে অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ব নির্ধারিত রায়ের দিন নিজের করা রিট প্রত্যাহারের আবেদন করেন তিনি। এ ঘটনায় বিজ্ঞ আদালত সেলিম খান ও তার সহযোগীদের রিট খারিজ করেন এবং আদালতের সময় নষ্ট করায় সেলিম খান ও তার দুই সহযোগীকে কোটি টাকা জরিমানা করা হয় এবং তার রিট খারিজ করা হয়। এর মধ্যে সেলিম চেয়ারম্যানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার অপর দুই সহযোগী রিটকারী আবদুল কাদের ও জুয়েলকে ২৫ লাখ করে মোট ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ৯ জুন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিকে বাড়তি দামে জমি বিক্রির চেষ্টার অভিযোগের পর সেলিম খানের অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। চাঁদপুরের নদী অঞ্চলে শত শত ড্রেজার বসিয়ে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে সেলিম খান বালু উত্তোলন করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙনসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। পরে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
ওই চিঠির পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ। তবুও বালু উত্তোলনের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। যা সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় তার অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন।
এদিকে গত ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও পদ্মা-মেঘনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। এদিকে, গতকাল সেলিম খানের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করতে যাচ্ছে তার দুর্নীতি অপকীর্তিতে- এ কথা বিভিন্ন মাধ্যমে গতকাল প্রচার হতে থাকলে চাঁদপুরবাসী সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। সাধারণ জনগন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগসহ রাজনৈতিকদলগুলো দুদককে এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগ করার সংস্থার উদ্দেশ্যে বলাবলি করছে, তার বিরুদ্ধে মামলা ও অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply