‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর আর জাগা পাইয়া ভালো আছি, কইতে পারি আমার বাড়ি আমার ঘর’

সরজমিন : লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়ন

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :
চাঁদপুর শহর থেকে ৫ কিলো দূরের গ্রাম লক্ষীপুর। সবুজ শ্যামল এই গাঁয়ে ঠাঁই নিয়েছে কতেক মানুষ। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেঁধেছেন এখানে। তারা হলেন নদী প্রমত্তা মেঘনার ভাঙ্গণের শিকার গৃহহীণ অসহায় দুঃস্থ মানুষ। আর এই গৃহগুলোর মালিক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের লক্ষীপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেলো, ৫২টি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সদরের ৫৭ টি ঘরের মধ্যে এখানেই ৫২ পরিবারের বসবাস।

মঙ্গলবার বিকালে ওই ঘরগুলোর আঙ্গীনাগুলোয় গিয়ে দেখা গেলো, ছোট ছেলেমেয়েরা বেশ হৈ-হুল্লোড় করছে। নিজেদের পাওয়া ঘরের সামনে একে অপরের সাথে খেলায় মজেছে। এদের বাবা মায়ের কেউবা সন্ধ্যাকালীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কেউবা নিচ্ছেন রাতের রান্নার প্রস্তুতি। আবার কাউকে দেখা গেলো বিনোদন পেতে ঘরে বসেই টিভি ছেড়ে নানান অনুষ্ঠানাদি দেখছেন।


দেখা হয়ে গেলো প্রধানমন্ত্রীর ঘর পাওয়া উপকারভোগী এক সময়ের মেঘনার করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারানো মমতাজ বেগমের সাথে। নিজে থেকে এগিয়ে এসে সালাম দিলেন। কেমন আছেন বলতেই জানালেন, ‘আল্লাহ অনেক ভালো রাখেছেন। অনেকবার প্রমত্তা মেঘনার ভাঙনের শিকার হইছি। মেঘনা নদী যখন আমাদের বাড়িঘর ভাঙলো, তহন প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় পাকা ঘর পাইলাম। জায়গা পাইলাম। সেই ঘরের একটা পাকা দলিলও পাইলাম। এই সময়ে এই পাওনডা আমগো লাইগ্গা অনেক কিছু।’


একটু এগুতেই দেখা মিললো আরেক উপকারভোগী ষাটোর্ধ প্রতিবন্ধী প্রান গোপাল ও তার স্ত্রী সাবিত্রীর সাথে। নৃ- গোষ্ঠী সম্প্রদায়ভুক্ত (ত্রিপুরা) মাত্র ১টি সন্তানের জনক ও জননী এই দম্পতি নিজেদের এই ঘর খুব চমৎকারভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন। ঘরে আছে ডিস লাইন। সেখানে ১ম কক্ষে বসে তারা বেসরকারী একটি টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছেন। মনে হলো শহরের কোন বাসা বাড়িতে তাদের বসবাস। বললেন, তাদের ঘরবাড়ি একাধিকবার মেঘনা গ্রাস করেছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেলিম খানকে জানিয়ে এবং উপজেলা প্রশাসনের বাছাই পর্ব শেষে সেই ঘরের স্থায়ী মালিক হয়েছেন।
সাবিত্রী বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মাথা গোঁজার ঠাই দিলেন। তার জন্য আশীর্বাদ।

চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের লক্ষীপুরে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া গৃহে বসে নারীরা ব্যস্ততায় ঘর সংসারে কাজে

আরেক উপকারভোগী ষাটোর্ধ আব্দুর রহমান। যিনি ৫ সন্তানের জনক। কথা বলতেই বললেন, মাছ ধরা তার পেশা। নদীতে এখন মাছ না পাওয়ার কারণে নদীতে যাচ্ছেন কম। দুই সন্তান মানসিক রোগী। এক সময় তার মাথা গোঁজার ঠাই পর্যন্ত ছিলো না। আর তার ওপর দালানের পাকা ঘর তুলা তো দূরের কথা।
আব্দুর রহমান জানান, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরে উঠেছেন। সেই থেকে এই সময় পর্যন্ত সাংসারিক কিছু সমস্যা থাকলেও ঘরে নিরাপদে থাকার বিষয়টাই হৃদয়ে একমাত্র শান্তি দেয়। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি দোয়া করেন।
আরেকটু এগিয়ে গেলে ৩ সারিতে নির্মাণ করা একটি ঘরে ঢুকতেই দেখা গেলো, ঘরে ফ্যান ঘুরছে। রান্না ঘরে কেউ একজন রান্না করছে। নামটি না জানা গেলেও ঘরের মধ্যে তিনি মাংস রান্না করছেন। নিজেরাই মাংস রান্না করছেন। পর্দানশীল ঐ মহিলাকে বেশ হাসিখুশি লাগলো। প্রায় ২৫ মিনিট সময় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য ঘর পাওয়া রুবেল ত্রিপুরা, পিংকী ত্রিপুরা, দুলাল ত্রিপুরা, মেঘনাথ ত্রিপুরা, চম্পা ত্রিপুরা, রানী ত্রিপুরা, সীমা ত্রিপুরাসহ আরো বেশ কয়েকজন ঘরের মালিকের সাথে কথা হলে তারা জানান, গৃহ শূণ্য জীবনে তাদের কষ্টটা যে কতটা বর্ণনাতীত ছিলো। সেই বিষ নিঃশ্বাসের তারা এখন অক্সিজেনে নিশ্বাস নিচ্ছেন। আর শুধু বলেছেন গেলো এই দের’দু মাসে পাকা এই ঘরে উঠে বেশ শান্তিতে আছেন। সবার মুখে কথা একটাই- ‘এহন কইতে পারি এটা আমার জাগা আমার ঘর।’ প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি পেয়েছেন তারা। এমনকি ঘরগুলোর কোন রকমের ত্রুটির অভিযোগ পাওয়া গেলো না। বরং কেউ কেউ বলছেন- ‘যেখানে ঘরই ছিলো না আমাদের। রাতে দিনে বৃষ্টিতে গা ভিজতো। সেখানে পাঁকা ঘরে আসছি এটাই অনেক সৌভাগ্য আমাদের। তাছাড়া ডিসি, ইনু স্যাররা (ইউএনও), আমগো খবর লয়। একটু আধটু সমস্যা সৃষ্টি হলে চেয়ারম্যান মেম্বার দৌড়ে আসেন, আসেন ইউএনও। তবে গত উঠার পর থেকে তারা তেমন কোন সমস্যাই পড়েননি। জনস্বাস্থ্য পাকা টিউব ওয়েলগুলো বসিয়ে দিয়েছে।’

এদের গৃহ ছেড়ে বের হওয়ার সম্মুখেই দেখা গেলো, চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ এদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, চাঁদপুর সদরে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ৫৭টি ঘরের ৫২টিই লক্ষীপুর গ্রামে করা হয়েছে।তিনি বললেন,এখানে আমাদের ত্রিপুরা নৃ-গোষ্ঠীর ১৩টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোও সহ-অবস্থান করছে। এটি মুজিববর্ষে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একটি দৃষ্টান্ত বলতে পারেন। তিনি বলেন, এদের গৃহ নির্মাণের বিষয়ে আমাদের জেলা প্রশাসক সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেছেন এবং এখনো আমরা তার নির্দেশনাতেই কাজ করে যাচ্ছি। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের এই ঘরগুলো করতে পেরে আমরা নিজেরাও তৃপ্ত। একটি মানুষও যেন গৃহহীন না থাকে প্রধানমন্ত্রীর এই কথাটি যেদিন তিনি মুখ থেকে বের করেছেন। সেই থেকেই আমরা তার নির্দেশনায় তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এছাড়া জেলা প্রশাসনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় আমরা আরও ২টি গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছি। এরা আগামী দিনে ভালো থাকলেই আমাদের এ কাজে নামাটা স্বার্থক ও সফল।
এদিকে বুধবার দুপুরে কঠোর লকডাউনে এই কর্মহীন মানুষগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা নিয়ে হাজির হলেন, জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ। চাল, ডাল তেলে লবন চিড়াসহ প্রায় ১ সপ্তাহের খাবার ৫২ পরিবারে দিলেন তিনি। বিতরণকালে স্থানীয়ও সাংসদ শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনিও ভিডিও কলে যোগ দিয়ে এই মানুষদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তারা তাকে জানালেন, আপা প্রধানমন্ত্রীর ঘর পাইয়া, জাগা পাইয়া ভালা আছি। এসময় ছিলেন, ইউএনও সানজিদা শাহনাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু।
গৃহগুলোর নির্মান, জায়গা নির্ধারণ সম্পর্কে অন্জনা খান মজলিশের সাথে কথা হলে তিনি জানান, এই প্রকল্প খোদ প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প। তাই শুরু থেকেই আমার মনিটরিং ছিলো অনেক। শুধু এখানেই নয়, পুরো জেলাতেই টেকসই ঘর নির্মান, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহসহ সকল বিষয়গুলো অনেক নজরদারিতে রেখেছি। মুজিবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের অর্থায়নে এই ভূমিহীন ও অসহায় মানুষদের জায়গা, তার দলিল, একটা সুন্দর ঘর করে দিতে পারলাম, এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কিছুতে কী পাবো? পাবো না।

শেয়ার করুন

Leave a Reply