চাঁদপুরের জঙ্গলে পাওয়া সেই মসজিদ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ৩ বছর
ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :
অনিয়ম, অবহেলা, উদাসীনতা এবং করোনার প্রভাব- এই চার জাঁতাকলে পড়ে গত তিন বছর আগে চাঁদপুরের ছোট সুন্দর গ্রামের ব জঙ্গল সাফ করে পাওয়া সুলতানি আমলের সেই মসজিদটি এখন যে কোনো দিন ধসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর জন্য বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেকই জলে গেছে। এখন সেখানে আবার জঙ্গল তৈরি হচ্ছে। মসজিদের গম্বুজটি ফাঁক হয়ে আছে। গত এক বছর আগে, খোদ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক ড. আতাউর রহমানই এমন মন্তব্য করে অধিদপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন। যিনি শুরু থেকেই মসজিদটি তদারকি করে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, এটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে ৮ লাখ টাকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়েছিল, তার ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা অধিদপ্তরের আদেশবলে ফেরতও পাঠানো হয়েছিলো।
করোনার আগে বাকি ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকার কাজ করানো হয়েছে। বাকি ৪ লক্ষাধিক টাকা এ জুনেই ফেরত যাচ্ছে।
২০২০ সালের করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. হান্নান মিয়া মসজিদটির অপরিকল্পিত সংস্কার কাজ দেখে চরম ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং কাজটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। অধিদপ্তরের সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা মসজিদটির কাজ সম্পূর্ণ নকশাবহির্ভূতভাবে করছিলেন। ঐতিহাসিক নিদর্শনকে জানান দেওয়া মসজিদের চারশ’ বছরের পুরোনো লাল রংয়ের শত শত সরু ইট কুড়াল-হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে ফেলে দেওয়া হয়। তার স্থলে ইটভাটার সাধারণ মানের ইট বসানো হচ্ছিল। এতে বরাদ্দের প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়। এই পরিস্থিতি দেখে যারা এ কাজ করেছেন, তাদের জবাদিহি করতে হবে জানিয়ে তিনি চলে যান। তার যাওয়ার পাঁচ মাস পর ওই বছরেরই ৭ জুলাই ঢাকা থেকে উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান, সহকারী পরিচালক মহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক ড. আতাউর রহমানের সমন্বয়ে তদন্ত টিম মসজিদটি পরিদর্শনে আসে।
মসজিদটির কাজ কবে শুরু করা হবে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি মো. হান্নান মিয়া ফোনে জানিয়েছিলেন, মসজিদের এই কাজটি করতে গিয়ে তাদের ভুল হয়েছে। যে প্রকোশলী ও ঠিকাদার কাজটি করেছেন তারা কোনোভাবেই কাজটি ঠিক করেননি, যা হওয়ার তা তো হলোই। কিন্তু এখন আটকে গেল করোনার জন্য। তিনি বলেন, মসজিদের বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য তদন্ত টিম পাঠানো হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এটির কাজ আবার শুরু হবে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
সেসময়ে তদন্ত টিমের সঙ্গে থাকা ঢাকা সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক যিনি এই মসজিদটির সংস্কারে শুরু থেকেই আছেন ড. আতাউর রহমান, তিনি বলেন, ২০২০ সালের জুন মাসের আগেই প্রকল্পের অবশিষ্ট টাকা আমাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আমি তা ফেরত দিয়েছি।
এই ঘটনার পর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবারো প্রকল্পের বাকি চার লাখ টাকা চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ দিয়ে নতুন প্রকৌশলী ঢাকা অঞ্চলে কর্মরত ফিরোজ আহমেদকে বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে কাজটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য চিঠি লিখে চট্টগ্রাম সিলেট অঞ্চলের পরিচালক আতাউর রহমানকে জানান। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, পরিচালকের নির্দেশনামার এক বছর পরেও আজ অব্দি ওই মসজিদের কাজটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। টাকা আছে, লোকবল আছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের লোকজনের মাঝেমধ্যেই এ মুখ থুবড়ে পড়া মসজিদ দেখতে আসা যাওয়া আছে, কিন্তু মসজিদের কাজটিতে হাত লাগানো হচ্ছে না। কেন এই ছোট একটি মসজিদের কাজ নিয়ে এত বিলম্ব, এই প্রশ্ন করলে এই অঞ্চলের পরিচালক জানান, আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তিনি কাজটি করতে আসেননি। তাছাড়া, দিন কয়েক আগে আমাকে এই অঞ্চল থেকে বদলি করা হয়েছে ঢাকায়। তিনি আরো জানান, খুব দ্রুত কাজটি সম্পাদন করার জন্য আমি অধিদপ্তরে চিঠি লিখেছিলাম। ওই চিঠির জবাবে বলা হয়েছিলো, গেলো ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এর কাজটি সম্পাদন করতে। কিন্তু তা হয়নি। সবশেষ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রধান অফিস থেকে জানানো হয়, চলতি মাস ১৪ মে থেকে ৩০ মের মধ্যে মসজিদের কাজটি শেষ করার জন্য। কিন্তু ২৮ মে পর্যন্ত মসজিদ সংস্কারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কেউই জাননি। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক নিদর্শন এই মসজিদের জন্য যে প্রকৃতির ইট ( সাতক্ষীরার তৈরি) দরকার তা সাইটেই আসেনি।
এদিকে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়া প্রকৌশলী ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমি ঢাকা অঞ্চলে কর্মরত। আমাকে নিতে হলে চট্টগ্রাম ও সিলেট অন্চলের দায়িত্বে থাকা পরিচালককে চিঠি দিয়ে বলতে হবে। আমি এমন কোন নির্দেশনা পাইনি। এটি না পেলে আমি যাবো কেন? আর এটা অধিদপ্তরের নিয়ম। এদিকে একই অধিদপ্তরে কর্মরত ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক যার পৈতৃক নিবাস একই গ্রামে এবং মসজিদটা থেকে মাত্র আধা কিলো দূূূরে, তারা সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি সত্যিই লজ্জিত এবং অনেক বিব্রত। ৩ বছরেও মসজিদটির মূল অবযব এবং সংস্কার আনতে পারলো না? আমি আমার এলাকার শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির নির্দেশ পেয়ে ২০১৮ সালে মসজিদটি যখন বের করে আনা হয় তখন গেছি। সাবেল মহাপরিচালকের সাথে গেলাম। আমি অন্য অঞ্চলে কাজ করি। এখানে হস্তক্ষেপ আমার নিয়মমতোই আমার চলে না! তবুও অনেক মিটিং এ আমি বলেছি। কিন্তু দাঁড় করাতে এতোটা বছর লাগছে কেন – আমার জানা নেই। এলাকার মানুষ হিসাবে কষ্ট লাগা ছাড়া কিছুই করার নেই আমার।
এ ব্যাপারে, সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়ের চেয়ারম্যান আল মামুন পাটওয়ারী জানান, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এই ইউনিয়নের বাসিন্দা স্থানীয় সাংসদ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি নিজেই বই পড়ে এই মসজিদের সন্ধান পান এবং নির্দেশ দেন জঙ্গল সাফ করতে। পরে আমরা সুুবিশাল জির গাছ আর অন্যান্য ঘন ছোটবড় বৃক্ষলতাদি কেটে মসজিদটি বের করে আনি। এর ক দিন পর তিনিও মসজিটি দেখতে আসেন। হাজার হাজার দর্শানার্থী এবং সাংবাদিকরা আসেন সুলতানি আমলের এ মসজিদ দেখতে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে ঐতিহাসিক নিদের্শন স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। জেলা ও উপজেলা প্রসাসন এগিয়ে আসে। অধিদপ্তরের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় সংস্কারের জন্য। অন্তত ২০/২৫ বার তারা এসেছেন, এবং আসছেন। কিন্তু সবই লোক দেখানো। চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি এখন আমাদের জন্যও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই জঙ্গলেই না হয় পড়ে থাকতো মসজিটি! সেই তো ভালো ছিলো।
ঐ এলাকার কলেজ পড়ুয়া তরুণ তারিক বলেন, আমাদের মন্ত্রী প্রতিশ্রতিও দিয়েছিলেন মসজিদটিকে ঘিরে তিনি পর্যটন এলাকা তৈরি করে দেবেন। মন্ত্রী অবশ্যই করে দিতে পারেন। কিন্তু এদের এই অবহেলা উদাসীনতা, ভুল কাজে এখন এই ঝড়ের দিনে মসজিদটা দাঁড়িয়ে থাকবে কিনা – তাই সন্দেহ।