নৈসর্গিক নেত্রকোণা : নয়নের কোণা থেকে অন্তরের অন্তস্তলে যার অবস্থান
— মারুফা সুলতানা খান হীরামনি
এক নয়ন যেমন আরেক নয়নকে দেখতে পায় না তেমনি হৃদয়ের মাঝে অতি সন্তর্পণে কিছু সৌন্দর্য লুকায়িত থাকে যা হৃদয় খুলে কখনো অনুধাবন করা হয় না। তেমনই যার ডাকে বারবার ফিরে যাই, যাকে আজীবন জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থান দিয়েছি, যাকে সব সময় সাথে নিয়ে ঘুরি, যাকে ভালোবেসে চোখ ফেরানো যায় না, সে আমার জন্মস্থান, আমার অতি আপন, আমার আদি চেনা নৈসর্গিক নেত্রকোণা।
সৃষ্টিকর্তা জন্মের জন্য যেমন মাতা-পিতা নির্ধারণ করেন, একই সাথে নির্ধারণ করেন জন্মস্থান। মায়ের মতোই আপন এই জন্মস্থান। মা ও জন্মের মাটি একে অপরের পরিপূরক। কাউকে ছেড়ে কাউকে রাখা যায় না। মায়ের জঠোর থেকে বের হয়েই চোখে আঁচড়ে পড়ে জন্মস্থান। জীবনে প্রথমবার চোখ মেলে আমিও আমার জন্মস্থান দেখেছিলাম অবলীলায় ভাবলেশহীন ভাবে। আস্তে আস্তে সেই জন্মস্থান তার বুক পেতে ধরেছিলো আমার ছোট্ট পা দুখাণি মেলে ধরার জন্য। আমি দাঁড়ালাম জন্মস্থানের মাধ্যমে ধরণীর বুকে। মায়ের মুখের ভাষাকে নিজের মুখে নিলাম জন্মস্থানের আলো বাতাসের ছোঁয়ায়।
ছোট্ট একটা নদী ধনু। যে নদীতে পাওয়া যেতো বিশাল বিশাল বোয়াল, চিতল, কাল বাউশ আরও বহু রকমের মাছ। কাল বাউশ মাছ ভাজার সুগন্ধে মৌ মৌ করতো হাওর অঞ্চল মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রাম। বহু জাতের মাছের আধার ধনু নদীর ওপারে রাজীবপুর গ্রাম। ঐ গ্রামে আছে একটি স্কুল। নৌকা দিয়ে নদী পার হতেই নলখাগড়ার বাগান। নলখাগড়াগুলো ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেই স্কুল। চাচাতো ভাই বোনদের সাথে বেড়াতে যাওয়া স্কুলে কে যে আমার পরীক্ষা নিয়েছিলো ঠিক স্মরণে নেই। কিন্তু আমার মায়ের শিখিয়ে দেয়া অ আ ক খ আমাকে পরীক্ষায় উতরে দিলো। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অ আ ক খ শিখার দিন শুরু। বরান্তর নামক দ্বীপসদৃশ গ্রামটিতে হাতে খড়ি হলেও পিতৃদেবের সদগুণে নিজেকে পড়াশোনায় সমৃদ্ধ করার জন্য পাড়ি দিয়েছিলাম মফস্বল মোহনগঞ্জে।
নেত্রকোণার সোমেশ্বরী নদী তীরে লেখক
মোহনগঞ্জের পাইলট প্রাইমারি স্কুলের প্রথম বন্ধু সীমা আজও হৃদয়ের একই জায়গায় বসবাস করে কিন্তু তাকে তা কখনো জানানো হয় নি। আজও মনে পড়ে সেই সরল অংকের স্মৃতি। একটি মাত্র চিহ্নের ভুলের জন্য অংকে ১০০ তে ৯৫ পাওয়া। আমার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন আমার জন্মদাতা পিতা। পরীক্ষার ঘন্টা পড়ার পরে হলে আব্বার কাছ থেকে আমার হাতে পৌঁছানো জলরঙের বক্সটি এখনো দুচোখে ভাস্বর। এমন একজন দায়িত্বশীল শিক্ষিকা ছিলেন যিনি আমার পরীক্ষার সারা বাংলা খাতা যাচাই করে একটি চন্দ্রবিন্দুর কমতি খেয়াল করে শব্দটির উপরে লাল কালির গোল্লা এঁকে দিয়েছিলেন। সেই চন্দ্রবিন্দুটি এখনো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। প্রাইমারি স্কুল শেষে হাই স্কুলে আসলাম। একই বাউন্ডারি। পরিবর্তন হলো শুধু বিল্ডিং। পেলাম বেশ কতজন নতুন বন্ধু। নবম শ্রেণিতে উঠে আমরা মেয়ে বন্ধুরা পরিণত হলাম ওরা ১১ জনে। টাকেরহাটে ঘুরতে যেতে পারি নি সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। টাকেরহাটে যেতে পারলে হয়তো ভুলে যেতাম কিন্তু যেতে পারি নি বলেই বেশি মনে পড়ে। এখনো মনে আছে ইসমত আপার এমব্রয়ডারি করে দেয়া সবুজ জামা পড়ে নদীর পাড়ে বনভোজনের কথা। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর মধ্যে এখনো কারোর কারোর চেহারা মনে পড়ে। তাদের সাথে সখ্যতা না গড়ার জন্য তাদের মুখ থেকে শোনা “এতো ভালো, ভালো না”, কথাটিও কানে বাজে।
যে নারীদের অবদানে জীবন আমার সমৃদ্ধ তাদের মধ্যে অন্যতম আমার নানুর কাছে হাই হীল জুতো পরতে চাওয়ার আবেদন আর সেই জুতো পাওয়ার আনন্দ এখনো মনকে আন্দোলিত করে। মাটির রাস্তায় পেন্সিল হীলের ছোটো ছোটো গর্তগুলো চোখে ভাসে। সুসং দুর্গাপুর ও বিরিশিরিতে চীনামাটির পাহাড় দেখতে যাওয়ার সময় মোটর সাইকেলের পিছনে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে শীতল হাওয়ার স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে পড়ে গিয়ে মাথায় যে ব্যথা পেয়েছিলাম তার দাগ এখনো থাকলেও মনে দাগ কেটে আছে সোমেশ্বরী নদীর বুকে পড়া চর।
গ্রীষ্মের ছুটিতে নানুর বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত নানাভাই আম খেতেন না। আম কাঁঠালের ছুটি আসতে তখন কেন যে এতো সময় লাগতো। জাম্বুরার ভিতরে লাল টুকটুকে রসালো কোয়া এখনো হাতছানি দেয়। শীতের সকালে মুক্তার পাটিতে বসে নানাভাইয়ের সাথে বারান্দায় বসে মুলাশাক, পুঁটি মাছ ভাজা, বড় বড় বিচিওয়ালা শীমের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া। নানাভাই খেতে বসার আগে তার নিজের হাতে চাষ করা ক্ষেত থেকে কচকচে মুলা আর কাঁচামরিচ তুলে নিয়ে আসতেন। মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা মাসকলাইয়ের ডালের মনমাতানো সুগন্ধ এখনো জিভে জল আনে। পলাশ ফুলের মতো রঙিন লাল রঙের চিংড়ি মাছ ভাজার কথা মনে হলে জন্মস্থানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই মুহুর্তেই। এই স্বাদ, গন্ধ, রঙ ও মমতার চিংড়ি ভাজা দেশের আর কোথাও নেই তেমনই ট্রলার দিয়ে ডিঙাপোতা পাড়ি দেয়ার সময় হাওরের বড় বড় ঢেউগুলো যেমন বুকে কাঁপন তুলতো তেমন কাঁপনও এখন আর কোথাও নেই।
মাকে বহুদিন না দেখে থাকলেও যেমন তাঁর চেহারা স্মৃতিতে অমলিন থেকে যায়, জন্মস্থানও ঠিক তাই, এর স্মৃতি কখনো মলিন হয় না। জন্মস্থান থেকে শত সহস্র মাইল দূরে থেকেও চোখের কোণে, মনের গহীনে আমার জন্মস্থান, আমার বেড়ে উঠা, আমার স্মৃতির আল্পনা, আমার পরম ভালোবাসা, আমার নৈসর্গিক নেত্রকোণা খেলা করে।
লেখক পরিচিতি :
মারুফা সুলতানা খান হীরামনি
সিনিয়র সহকারী সচিব
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
বর্তমানে শিক্ষা ছুটিতে দক্ষিণ কোরিয়ার KDI School of Public Policy and Management এ অধ্যয়নরত