চাঁদপুরের ৪০ ভাষা সংগ্রামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও
পরিবারের সদস্যরা চায় তাদের সম্মানটুকু
ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :
বায়ান্নের শহীদদের রেখে যাওয়া রক্তের ঋণের যথার্থ মূল্যায়নে সারা দেশের ভাষা সংগ্রামীর মহান ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৭০ বছর পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন ভাষা সংগ্রামী হিসেবে মর্যাদা পেলেও অনেকেই পাননি সংবর্ধনা বা সম্মাননা। তেমনি বঙ্গবন্ধুর সহপাঠীসহ চাঁদপুরের ৪০ ভাষা সংগ্রামীর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি আজও মেলেনি। যদিও ২০২০ সালে একটি রিট আবেদনে সারাদেশের ভাষা সংগ্রামীদের মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় তালিকা তৈরি এবং ভাতাদি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। কিন্তু দু’ বছর গড়িয়ে গেলেও তা হয়নি। তাদের পরিবারের মেলেনি ন্যূনতম কোন সম্মান। কেউ নেয়নি পরিবারের কোন খোঁজ-খবর। ভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে এখন আর কেউই বেঁচে নেই।
বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও ভাষা সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের হিসেব মতে জেলায় ৪০ জন ভাষা সংগ্রামীর নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বাবা এম এ ওয়াদুদ পাটওয়ারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চাঁদপুর মহকুমা যুবলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এ.এফ.এম ফজলুল হক, ডাঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী টুনু, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সাবেক এমপি আবদুর রব, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল আউয়াল, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য আইনজীবি সিরাজুল ইসলাম, সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল করিম পাটওয়ারী, রফিক উদ্দিন আখন্দ ওরফে সোনা আখন্দ, বিএম কলিম উল্ল¬াহ, মোল্ল¬া ছিদ্দিকুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট আবু জাফর মোঃ মাইনুদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবুল ফজল, হোমিও চিকিৎসক এ,বি খান, আবদুল করিম খান, সুজাত আলী মুন্সী, তৎকালীন তরুণ সংগঠক শাহ্ আমান উল¬াহ্ মানিক, সাবেক এমপি নওজোয়ান ওয়ালি উল্ল¬াহ, প্রবীন রাজনীতিবিদ আইনজীবি শেখ মতিউর রহমান, ডাঃ এম,এ গফুর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমপি ফ্লাঃ লেঃ (অবঃ) এ, বি, সিদ্দিক, মেজর জেনারেল অব. ডা. এম শামসুল হক, সাবেক এমপি হারুনুর রশিদ খান, হাফেজ হাবিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফ্ফর আলী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ আবদুস ছাত্তার, কবি শামছুল হক মোল্লা, আইয়ুব আলী খান, কর্ণেল অব. ডা. আহমেদ ফজলুুল মতিন, লে. কর্ণেল আবু ওসমান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল মমিন খান মাখন, অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, ডা. মতিউর রহমান, আবু নাছের মো. ওয়াহিদ, জয়নুল আবেদীন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমর উদ্দিন চৌধুরী, বিশিষ্ট নারী সংগঠক সাবেক এমপি আমেনা বেগম।
কয়েক বছর আগেও চাঁদপুরে একুশে ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠানে অসুস্থ অবস্থায়ও এসেছিলেন নূরুল হক বাচ্চু মিয়াজি। ২০১৯ সালে মারা যাওয়া ভাষা সংগ্রামী ডা. আব্দুল গফুর এবং তার পরিবারের চাপা আক্ষেপ হচ্ছে- প্রতি বছর রাজধানীভিত্তিক ২১শে পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা সম্মামনা প্রদান করলেও শহর গ্রামের বেঁচে থাকা কিংবা মরনোত্তর ভাষা সংগ্রামকে আজো রাষ্ট্র তাদের সম্মানটুকু দিচ্ছে না। হয়তো একদিন নামগুলো মুছেও যেতে পারে।
১৯৫২’র এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় মায়ের ভাষা ‘বাংলা’র জন্য প্রবল আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরেও গড়ে ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’। এই ইউনিটের নেতৃত্বে চাঁদপুরের এই কৃতি সন্তানদের অনেকেই ভাষার জন্য লড়াই করেছেন।
‘১৯৫২সালের ২৬শে ফেব্র“য়ারি তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা শহরে অবস্থিত আহম্মদিয়া মুসলিম হোষ্টেলে (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ হোষ্টেলে) গোপনে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’ গঠিত হয়। উপস্থিত সর্বসম্মতিক্রমে ইউনিটের সভাপতি মনোনীত হন তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নেতা আবদুর রব এবং তৎকালে কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র নেতা চাঁদপুর সদর উপজেলাধীন রাড়িরচর গ্রামের মোল্ল¬া ছিদ্দিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’ গঠনের সভায় যোগদান করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ভাষা সংগ্রামীসহ আরো অনেকে। পরে তৎকালীন ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’এর প্রতিনিধি হিসেবে চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় উলেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চাঁদপুরের তৎকালীন ৬টি থানা থেকে তাঁরা এসে এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করে তুঙ্গে নেন। এ ৪০ জনের মধ্যে অনেকেই সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
বেঁচে থাকা অবস্থায় ভাষা সংগ্রামী বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এম, এ গফুর স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘আমি তখন ঢাকা মেডিকেলের এম.বি.বি.এস-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ২১শে ফেব্র“য়ারির মিছিলে গাজীউল হক, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, আতাউর রহমান খান, আবুল কাশেম (অধ্যক্ষ আবুল কাশেম)-এর ঠিক পিছনে ছিলাম। আমি রাজপথে দেখেছিলাম বুলেটবিদ্ধ রক্তে রঞ্জিত ভাষা শহীদদের শরীর। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকা বুলেটবিদ্ধ সফিউর রহমানকে বাঁচানোর জন্যে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। জীবিত থাকা অবস্থায় ডাঃ এম, এ, গফুর আরও বলেন, ভাষা শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। না হয় প্রজন্ম একদিন গ্রামে-গঞ্জের ভাষা সৈনিকদের নামটাও ভুলে যাবে। তিনি বলেন, সনদপত্রই সম্মান সৃষ্টি করে না। যথোপযুক্ত মর্যাদা থাকতে হবে ভাষা সৈনিকদের। কারণ, ভাষা দিবস পৃথিবীর এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
আরেক ভাষা সংগ্রামী নূরুল হক বাচ্চু মিয়াজি। ৮৭ বছর বয়সে গত বছর না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। ’৫২ ভাষা আন্দোলনের সময়ে ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ভিপি। এছাড়া ত্রিপুরা জেলার ছাত্রলীগ সভাপতি। দু’বছর এমন দিনে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন। জীবত থাকা অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি চাঁদপুরের কৃতী সন্তান এমএ ওয়াদুদের নেতৃত্বে আমরা তখন ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের প্রেরণা। তিনি বলেছিলেন, বেশিদিন হয়তো আর বাঁচবো না। কিন্তু মৃত্যুর যদি দেখে যেতে পারতাম রাষ্ট্র আমাদের ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতিটুকু দিয়েছে। তাহলে শান্তি পেতাম। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী সরকার। বঙ্গবন্ধু কন্যা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে যতটা আন্তরিক হয়ে উঠেছেন আমি আশা করবো চাঁদপুরসহ সারা বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকদের পুরো নাম তালিকা নিয়ে তিনি তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সম্মাননা প্রদান করবেন। কিন্তু তার এই আশা পূরণ হওয়ার স্বপ্নসাধের আগেই স্বীকৃতি না পেয়েই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ভাষা সংগ্রামী শেখ মোজাফ্ফর আলীর ছেলে শেখ মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, এতো বছর পরেও চাঁদপুরের এই ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া কষ্টের। আমার বাবা মৃত্যুর আগে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থাও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা পাননি। আমার বাবা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, কাজ করেছেন- তখন কিন্তু তারা এই স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেননি। মাতৃভাষার জন্য কাজ করেছেন সেটিই বড় কথা।
তিনি বলেন, আমরা চাই- সরকার তাদের তালিকাভূক্ত করুক এবং আশা করি, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পাবেন।
ভাষা সংগ্রামী কমর উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে কেন্দ্রীয় কৃষকলীগ নেতা সারওয়াদ ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, বাবা ১৯৪৯ সালে মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে সচিবালয় গেইটে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকও ছিলেন। ভাষা সংগ্রামীর ছেলে হিসেবে গর্ববোধ করি। কিন্তু এই সৈনিকদের আজো মূল্যায়ণ করা হয়নি। যা অত্যন্ত জরুরী। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতাদি না হোক সনদ, সম্মান এবং তাদের পরিচয়গুলো তুলে ধরা হোক। তাতে প্রজন্ম উপকৃত হবে। ইতিহাস বিকৃত হবে না।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয় সম্মান, সম্মানি ভাতা ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা গেজেট আকাওে প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ওই বছরের ৮ মার্চ আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভাষা শহিদ ও ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।