চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনায় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত নৌযান জব্দ ও জড়িতদের গ্রেফতারের নির্দেশ
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বৈঠক : যারা এ ধরনের অবৈধ কাজ করতে সহযোগিতা করে তারা জাতির শত্রæ : ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী
ইব্রাহীম রনি :
চাঁদপুরের পদ্ম-মেঘনায় শত শত ড্রেজার বসিয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলা বালু উত্তোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নৌযানগুলোকে জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সেই সাথে এ অপকর্মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা হিসেবে গ্রেফতারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গতকাল ২১ মার্চ সোমবার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর, বিআইডাবিøউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের পর এ নির্দেশনা দেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী।
২২ মার্চ মঙ্গলবার থেকেই নদীতে বালুখেকোদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা পরিচালনা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে আসছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের একটি চক্র। ইলিশ সম্পদ রক্ষা, নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নদী ভাঙন প্রতিরোধে এবারই প্রথম বালুখেকোদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিলো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
সোমবারের বৈঠকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ক্ষতির দিকসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন নদী রক্ষা কমিশনের সচিব মঞ্জুরুল কাদের, নদী রক্ষা কমিশনের উপপরিচালক মো. আকতারুজ্জামান তালুকদার, ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইকরামুল হক, নদী রক্ষা কমিশনের উপ পরিচালক ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম, এমএম মহিউদ্দিন কবির মাহিম, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. ছগির আহমেদ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসরিন আনম সাথী, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সহকারী সচিব মাহনাজ হোসেন ফারিবা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত¡াবধায়ক মো. জাকির হোসেন, মৎস্য অধিদপ্তরের উপ প্রধান মাসুদ আরা মমি, ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের ন্যচারাল রিসোর্স বিশেষজ্ঞ মো. মিজানুর রহমান, ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের এনভয়রেনমেন্ট বিশেষজ্ঞ মো. মনির হোসেন চৌধুরী, বিআইডাবিøউটিএর যুগ্ম পরিচালক মো. আব্দুর রউফ, উপপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর ড. মো. ইউসুফ আলীসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ।
এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জেলা প্রশাসকের চিঠির প্রেক্ষিতে আজকে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়াও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, দেশের নদীগুলোতে ইলিশের যে অভয়ারন্য রয়েছে তার মধ্যে একটি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এলাকা। এর মধ্যে চাঁদপুরের নদী এলাকা রয়েছে ৭০ কিলোমিটার। এটি হচ্ছে ইলিশের সবচে বড় অভয়ারন্য। মৎস্য বিজ্ঞানিরা জানিয়েছেন- এই এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে ইলিশের খাবার কমে গেছে। এ অঞ্চলে ইলিশ আসা কমে গেছে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যগুলো শুনে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা তাদেরকে একটা সুপারিশ করেছি।
তিনি আরও বলেন, নদীর গার্ডিয়ান হিসেবে নদী রক্ষা কমিশন করা হয়েছে। আমাদেরকে জাতীয় স্বার্থ দেখতেই হবে। ইলিশ যদি একবার দিক পরিবর্তন করে ফেলে তাহলে আমরা ইলিশ থেকে বঞ্চিত হবো। এটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যারা এ ধরনের অবৈধ কাজ করতে সহযোগিতা করে তারা জাতির শত্রæ। অবিলম্বের নদী থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে। পুলিশ, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ডসহ সকলের সহযোগিতা নিয়ে বালু ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বাল্কহেড জব্দ করতে হবে।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কমিশনকে জানিয়েছেন- উচ্চ আদালতের আদেশের কথা বলে তারা বালু উত্তোলন করছে। আমরা তাদেরকে বলেছি- আদালতের আদেশ অমান্য করার কথা বলিনি। আদালতের আদেশ মেনে যদি তারা করতো তাহলে এমনটি হতো না। আদালত তাদেরকে কয়েকটি নির্দিষ্ট মৌজায় ড্রেজিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সেই মৌজাগুলো কোথায় তার কোন ম্যাপও তাদের কাছে নেই। তাছাড়া আদালত তাদেরকে বালু বিক্রির কোন আদেশ দেয়নি। অথচ তারা এভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে। সুতরাং জেলা প্রশাসককে আমি বলেছি, তারা বালু যখনই অন্য জায়গায় নিচ্ছে তখনই এটি স্টোলেন প্রোপার্টি হয়ে যাচ্ছে। ডিসিও এ কথায় সম্মতি দিয়েছে এবং বলেছেন- তারা হচ্ছে চোর।
তিনি আরও বলেন, বালুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের তিনশতাধিক নৌযান রয়েছে সেগুলো সব জব্দ করার জন্য আমি জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছি। তাদের লাইসেন্স আছে কি না সেগুলো পরীক্ষা করতে হবে। তারা অবৈধভাবে বালু তুলছে। কারণ, মাটি এবং বালু উত্তোলন বিধি অনুযায়ী তা উত্তোলন করতে হবে সুইং করে বালু কাটতে হবে। সেটি তারা করছে না। আদালত বলেছে ড্রেজিং করার জন্য। বিআইডাবিøউটিএর সঙ্গানুযায়ী সুইং করে বালু কাটা- যাতে একটি সুশম স্তর তৈরি হয়। যেহেতু তারা তা করছে না তাই তাদেরকে আইনানুযায়ী গ্রেফতার করার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিআইডাবিøউটিএ’কে অ্যাকশন নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখানে যেহেতু পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে তাই অধিদপ্তরকে পরিবেশ আদালত চালু করার নির্দেশ দিয়েছি। এটি করার জন্য তাদেরকে কোন অনুমতি নিতে হবে না।
তিনি বলেন, আশাকরি- চাঁদপুরে মঙ্গলবার থেকেই প্রশাসন অভিযান চালু করবে। জেলা প্রশাসন যদি তা না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবো। এখানে কোন আইনি বাধা-বিঘœ নেই। তারা বলছেন, প্রভাবশালীদের ভয়ে তারা কাজটি করতে পারছে না। আমি তাদেরকে বলেছি, ভয় পেলে চলবে না। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি নির্দেশ দিয়েছি। নদী রক্ষায় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতেই হবে।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর জেলার নদী অঞ্চল থেকে গত কয়েক বছর ধরেই ‘অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের’ অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদী ভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। নদী ভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও স্থানীয়রা বিরোধিতা করলেও বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে প্রভাবশালী ওই চক্রটি। এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙনকবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজন দাবির প্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডাবিøউটিএ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। অবস্থা বেগতিক দেখে এর তিন দিনের মাথায় অবৈধ বালু ব্যবসার বৈধতা পেতে গত ২২ ফেব্রæয়ারি জেলা প্রশাসন ও বিআইডাবিøটিএর কাছে ১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা জমা দেয়ার আবেদন করে বসেন সেলিম খান। যদিও ডুবোচর খননের জন্য আদালত তাকে নির্দিষ্ট স্থানে ড্রেজিং করার অনুমতি দিলেও বালু বিক্রির কোন অনুমতি দেয়নি সরকার।
এ বিষয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনুর রশিদের দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চাঁদপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীতে ড্রেজারের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এই নদী থেকে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান ডুবোচর খননের নামে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে এই কাজটি করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। ফলে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ স¤প্রতি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে শত শত ড্রেজারের আঘাতে, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য নদীর প্লাংটন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এছাড়া বালু উত্তোলনে নদী দূষণসহ নদী গর্ভের গঠন প্রক্রিয়া বদলে যাওয়ার ফলে বাসস্থানের বাস্তুতন্ত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীক‚লের এই ধরনের পরিবর্তনের ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি ইলিশসহ অন্যান্য মাছের খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাছের বিচরণ ও প্রজনন বদলে যাওয়াসহ ইলিশের উৎপাদন মেঘনা নদীতে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইলিশ রক্ষা এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে প্রধান প্রজনন ও বিচরণ মৌসুমে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধসহ ড্রেজারগুলো স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
এছাড়া অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙন ও ক্ষতি সম্পর্কে জানিয়ে চিঠি দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডাবিø্উটিএ।