ধর্ষন কি মহামারী হয়ে এলো বাংলাদেশে?

অ্যাড. জেসমিন সুলতানা ::
এক জঘন্য অপরাধ যা একজন নারীর সতীত্ব কেড়ে নেয়, সে তার সম্ভ্রম হারায়,সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়, পারিবারিক মর্যাদা হানী হয়, তার স্বপ্ন, ভবিষ্যত কে দলে মুচড়ে চুরমার করে দিয়ে চিরকালের জন্য সে পঙ্গুত্ব বরণ করে এক কথায় সে জীবিত থেকেও মৃত যাকে বলে জীবনান্মৃত।
ধর্ষনকারীদের চোখে নারীর বয়স কোন বিষয় না দুবছরের মাসুম সন্তান থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধার উপর পৈশাচিক নির্যাতন তাদের বিবেককে নাড়া দেয়না, পাষন্ড হৃদয় স্পর্শ করেনা তারা জগতের নিকৃষ্টতম কীটে হয় পরিনত।
এখন সময় এসেছে জেগে উঠার প্রতিবাদী হওয়ার।আর ঘরে বসে থাকা সমিচিন নয়।। আজকে সব আক্রান্ত নারীদের সমব্যাথী হিসেবে নিজকে তাদেরই একজন মনে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,মাননীয় আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আপনাদের কাছে নারী সমাজের আবেদন,নিবেদন সময়ের দাবী এই যে,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের অসংখ্য কন্যা সন্তানের জননী, আমাদের বোন,মানবতার মা, আপনি নারীর ক্ষমতায়ন,নারীনির্যাতন প্রতিরোধে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছেন। আপনি আপনার কন্যা সন্তানের প্রতি,আপনার বোনের প্রতি আপনার বজ্রকঠোর, হাতটি বাড়িয়ে দিন।।বাংলাদেশের নারীদের দাবী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০( সংশোধন ২০০৩)টির বিভিন্ন ধারার আমূল পরিবর্তন ও সংশোধন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন২০০০ ( সংশোধন ২০০৩)ধর্ষনের নিম্নরূপ শাস্তির বিধান রয়েছে।
ধারা ৯ঃ ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি
১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
ব্যাখ্যা৷- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত [ষোল বৎসরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা [ষোল বৎসরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
” নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশোধন ২০০৩)
৯( ১) ধারার শাস্তির বিধান পরিবর্তিত করে
মৃত্যুদন্ডের বিধান, করা জরুরী, কেননা সে ৯( ২) ধারার শাস্তির বিধান মতো সে ও মৃত।।”
এখানে উল্লেখ্য ধর্ষনের মত কোন ঘটনা ঘটার২৪ ঘন্টার মধ্যেই মেডিকেল পরীক্ষা, ২২ ধারায় ভিকটিমের জবানবন্দী গ্রহন,ডি,এন,এ টেষ্টের নমুনা সংরক্ষন, অনিরাপদ সাক্ষী দের ২২ধারায় সাক্ষ্য গ্রহন ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেয়া হলেই আইনের ফাক ফোঁকরে আসামী বেরিয়ে যেতে পারেনা।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারা ১৮ তে তদন্তের সময় নির্ধারন করে দেয়া আছে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে টাকা পয়সা খেয়ে রিপোর্ট না দিতে পারলে তা তদন্তকারী কর্মকর্তার অদক্ষতা,অসদাচরন বলে বিবেচিত হবে,পরে অন্য একজন তদন্ত করবেন এ বিধান এতে ক্ষতিগ্রস্হের লাভ?
দীর্ঘ সময় ধরে মামলার চার্জ সীট না হওয়ার ফলে লাভবান ধর্ষনকারী আসামী।এখানেও ১৮( ক) বলবৎ থাকলেই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্হা গ্রহন সম্ভব।।
ভিকটিমদের ডাক্তারী পরীক্ষাটি দ্রুত করা হয়না ফলে গোসল করে,কাপড়ে থাকা আলামত সমূহ নষ্টকরে অনেক সময় কিছু পাওয়া যায়নি বলে মতামত পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের প্রতিটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে একজন নারী বিচারক ও নারী পাবলিক প্রসিকিউটর থাকা উচিৎ যেখানে সাক্ষী দেয়ার সময় ভিকটিম আইনজীবীদের জেরায় দ্বিতীয় মেয়াদে ধর্ষিত না হয়ে মন খুলে স্বাক্ষ্য প্রদান কারতে পারবে।
নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে চান্চল্যকর মামলা সমূহ দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্হা করে শাস্তি দেয়া গেলে অপরাধ প্রবনতা হ্রাস পাবে, মানুষ ও ভীত হবে।।
বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা মানুষের মনের ভয় দূর করে দেয়। বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারনেই মানুষ আজ ব্যাভিচারী, মৌলবী,মাষ্টার,ধর্মযাজক,শিক্ষক,রাজনৈতিক ক্ষমতাধিকারী, সাধারন জনগন কেউ আইনের তোয়াক্কা করেনা ভয় পায়না, চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মহামারীর মতো ধর্ষনের মতো ন্যক্কারজনক কাজ। দেশকে,দেশের মানুষকে করছে অস্হির ও আতংকগ্রস্হ।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের কাছে আবেদন করে নারী শিশু নির্যাতন আইনের আওতাধীন মামলা সমূহও,এসিড অপরাধ দমন আইনের মামলা সমূহের জন্য আলাদা হাইকোর্টে বেঞ্চ গঠন করা যায় কিনা যেখানে মামলা সমূহ দূর্নীতি দমন আইনের মামলা সমূহের মতো নির্দিষ্ট নারী বান্ধব কোর্টে হবে এবং প্রসিকিউশনে নারী সরকারী আইনজীবী রা থাকবেন।।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে বিগত ২০০২ সনের আগে থেকে এসিড নিক্ষেপ ও মহামারী হিসেবে এসেছিল।এসিড অপরাধ দমন আইন,
( ২০০২ সনের ২ নং আইন ) মাইল ফলক হিসেবে কাজ করেছে,মানুষ ভয় পেয়েছে তাই এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা অনেক কমেছে।
ধারা ৪- এসিড দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি
যদি কোন ব্যক্তি এসিড দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷ মৃত্যুদন্ড রাখার ফলে এবং কিছু ফাঁসি কার্যকর হওয়ার ফলে অপরাধ প্রবনতা বেশ কমেছে সাথে এসিড বিক্রয় নিয়ন্ত্রন আইনেরও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে।
হে ভগ্নি, কন্যা, মা, আপনারা জেগে উঠুন।
আপনার সন্তান,আপনার ভাই,আপনারই মতো কোন নারীর সর্বনাশ করে তার সাময়িক যৌনাকাঙ্খা মিটিয়ে আপনারই ঘরে স্বস্তিতে ঘুমিয়ে আছে। আপনি আপনার সন্তানকে,ভাইকে আইনের হাতে সোপর্দ করুন,দৃষ্টান্ত স্হাপন করুন।কোন মায়ের সন্তান যেন এ পৈশাচিক,ঘৃন্য,নেক্কারজনক অপকর্মে লিপ্ত না হয়।আমার ছেলে সৎ,আমার ভাই নিরপরাধ,আমার ছেলেকে শত্রুতা করে জড়িয়ে দিয়েছে, তার পক্ষালম্বন করবেন না।
পরিবার হলো একটি সন্তান গড়ার পীঠ স্হান।একজন সন্তানের বেড়ে ওঠে তার মা বাবা কে ধারন করে,অনুসরন ও অনুকরন করেই।।আমার সন্তান কি করছে,কাদের সাথে মিশছে, কাদের সাথে তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে, কার সাথে তার সখ্যতা মা -ই তা ভাল জানেন।। সুতরাং সন্তানের চলা ফিরা গতিবিধির উপর তীব্র নজর রাখা জরুরী।
এ করোনা সময়ে আমাদের মনে একটা মৃত্যু ভয় এসেছে আমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরন করছি ঠিকই কিন্ত কমেনি অপরাধ প্রবনতা।
বর্তমানে একমহাদূর্যোগ কাল অতিক্রম করছি।একদিকে করোনায় কেড়ে নিচ্ছে প্রিয় মুখ, আরেক দিকে চলছে ধর্ষনের হোলিখেলা।
সরকারের একার পক্ষে এ খেলা বন্ধ করা সম্ভব নয়।সবাই মিলে সামাজিক ভাবে এ অপরাধকে প্রতিরোধ করতে হবে,ধর্ষনকারীর পরিবার কেও সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে,ধর্ষনকারী শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান হলেই হয়তো বা অস্হিরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে দেশ।সবাইপাবে নারী নির্যাতন মুক্ত,ধর্ষন মুক্ত,নারীর জন্য নিরাপদ সুন্দর ঝলমলে সোনার বাংলাদেশ।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply